মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ০৩:৫১ পূর্বাহ্ন
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পর সুন্দরবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাণীটি হলো চিত্রা হরিণ। যাকে কখনও স্থানীয়ভাবে চিত্রল হরিণ, চিত্র মৃগ, চিতল নামে ডাকা হয়। হরিণ প্রজাতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এই চিত্রা হরিণ। চিত্রা হরিণ বিভিন্ন পার্ক কিংবা চিড়িয়াখানায় দেখা গেলেও খামারি পর্যায়ে কখনও পালনের কথা শোনা যায়নি। কিন্তু সেই অসাধ্য কাজটি করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের বাসিন্দা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান জেমস মৃদুল হালদার। উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার উত্তরের রাজিহার গ্রামে গড়ে উঠেছে বিভাগের একমাত্র চিত্রা হরিনের খামার।
বরিশাল বিভাগের মধ্যে একমাত্র এই চিত্রা হরিনের খামারটি ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আর কোথাও নেই। লাজুক স্বভাবের অথচ চঞ্চল প্রকৃতির এ হরিণের দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো দেখতে প্রতিদিনই এ খামারে ভিড় করছে অসংখ্য মানুষ। তবে বাণিজ্যিকভাবে হরিন পালনের সুযোগ না থাকায় বিপাকে পরেছেন এই খামারি। ২০১০ সালে রাজিহার ইউনিয়নের রাজিহার গ্রামে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা আলোশিখার পরিচালক ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শামূয়েল হালদারের ছেলে জেমস মৃদুল হালদার শখের বশে ব্যক্তি পর্যায়ে দুটি চিত্রা হরিণ পালন শুরু করেছিলেন। শুরুতে তিনি একটি পুরুষ ও একটি মেয়ে চিত্রা হরিণ রাজশাহী থেকে ক্রয় করে আনেন। রাজশাহী থেকে আনা হরিণ দুটি এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যায়।
এর কিছুদিন পরেই হরিণ পোষার নেশায় তিনি বগুড়ার শিয়ালী গ্রামের এক খামারির কাছ থেকে পুনরায় দুটি হরিণ ক্রয় করে আনেন। পরিবহন খরচসহ ওই দুটির দাম পরেছিলো এক লাখ টাকা। এর কিছুদিন পর হরিন বাচ্চা প্রসব করে এবং বছরে বছরে হরিনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ব্যক্তি পর্যায়ে হরিণ পালার শখ গিয়ে ঠেকে খামারিতে। সেই খামারে গত ১০ বছরে কখনো ১৬ কখনো ২২ কিংবা কখনো এর চেয়েও বেশি হরিণ বিচরন করে বেড়িয়েছে একসাথে। বর্তমানে তার খামারে ১৬টি হরিণ রয়েছে। খামারের মালিক জেমস মৃদুল হালদার বলেন, চিত্রল হরিন পোষা সংক্রান্ত নীতিমালা ২০০৯ অনুমোদনের পর শখের বশে তার হরিণ পালার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
২০১০ সালে দুটি হরিন সংগ্রহের পর পালন শুরু করি। কয়েকমাস পরেই সে হরিণ দুটি বাচ্চা প্রসব করলে ভাললাগা বেড়ে যায়। এরপর ধীরে ধীরে ব্যক্তি পর্যায় থেকে খামারি পর্যায়ে চলে যাই। ১০টির বেশি হয়ে যায় হরিণের সংখ্যা। বর্তমানে খামারে ১৬টি হরিন রয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে ২৬টি হরিণ ছিল খামারে। আটটি দান করা হয়েছে এবং দুটি মারা গেছে। রোগ বালাইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, হরিনের তেমন কোনো রোগবালাই নেই, তাই পালনটা সহজ।
শুধু হরিণের হার্টঅ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা একটু বেশি থাকে। তারপরেও গত ১০ বছরে আমার খামারে মাত্র দুটি হরিণ মারা গেছে। আবার আমার কাছ থেকে হরিন নিয়ে গাজীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জের তিনজনে হরিণ পালন শুরু করেছেন। তারমধ্যে গাজীপুরের হরিণগুলো দুটি বাচ্চাও দিয়েছে। আবার বরিশালের দুর্গাসাগরে দর্শনার্থীদের জন্য দুটি হরিণ আমার এই খামার থেকেই দান হিসেবেই দেওয়া। খাবারসহ আনুষঙ্গিক খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, হরিণ সবকিছু খায় না। বিশুদ্ধ পানি ছাড়া চিত্রা হরিণ অন্য কোন পানি পান করে না। এদের খাবারের তালিকায় রয়েছে গমের ভুসি, ডালের ভুষি, গুঁড়া সয়াবিন, মালঞ্চ-কলমি পাতা। এছাড়া কেওড়া ফল ও বাঁধাকপিও খেতে দিচ্ছি হরিনগুলোকে।
লালন-পালনে বিশেষ নজর রাখতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য আলাদা লোক রাখতে হয়েছে। ৪০শতক জমির ওই খামারটিতে মাঠের বাইরে আলাদা বসার ঘর করতে হয়েছে হরিনের জন্য। সুন্দরবন ছাড়া এ অঞ্চলে কেওড়া গাছ পাওয়া যায় না, তাই সেই গাছও আমাকে রোপন করতে হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া ও পরিচর্যায় গত ১০বছরে বহু পুঁজি খেটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাণিজ্যিক অনুমোদন অর্থাৎ হরিণ বিক্রির অনুমোদন না দেওয়ায় এ খাতে এখনও কোনো আয় নেই। তবে হরিণ যে দান করা হয় সেখান থেকে উপহার হিসেবে অনেকেই টাকা-পয়সা দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, প্রতিমাসে লালন-পালনে হরিন গুলোর পেছনে বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। আর এ খরচ শুধু শখের বশে পালন করি বলেই বহন করছি। যদিও পালন করে বড় করা একটি হরিন জবাই করে এর মাংস খাওয়াটাও মুশকিল।
কারণ এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ (বয়স্ক কিংবা অসুস্থতা) দেখিয়ে বন্যপ্রানী সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে অবহিত করে অনুমতি আনতে হয়। এর বাইরে হরিণের বাচ্চা হলেও বন্যপ্রানী সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হয়। প্রতিবছর একেকটি হরিণের জন্যে আগে একশ’ টাকা করে দিতে হলেও ২০১৮ সাল থেকে এক হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে সরকারকে। এছাড়া ১৫শতাংশ ভ্যাট। নতুন লাইসেন্স করা, নবায়ন করা সবকিছু মিলিয়ে দিন দিন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হরিণ বন্যপ্রানী হলেও গবাদিপশুর মতো পোষ মানে জানিয়ে জেমস মৃদুল হালদার বলেন, আমার খামারে সর্বোচ্চ সাত বছর বয়সের আর সর্বনিম্ন দুই মাস বয়সী হরিণ রয়েছে।
যার মধ্যে অনেকগুলোই গৃহপালিত প্রাণীর মতো কাছে আসছে, তাদের শরীরে হাত দেওয়া যাচ্ছে, আদর করা যাচ্ছে। তবে বেশি মানুষ দেখলে হরিণগুলো একটু ঘাবড়ে যায়। তাই বাধ্য হয়েই খামারের সীমানা প্রাচীরে দুটি স্তর করতে হয়েছে। তবে সবমিলিয়ে সৌখিন হলেও হরিণ পালন করা খুবই সহজ। জেমস মৃদুল হালদারের দাবি, যেহেতু চিত্রা হরিণ পোষমানে, সে কারণে বিলুপ্তি ঠেকাতে গবাদিপশুর মতো সরকারের এর খামারের অনুমোদন দেওয়া এবং বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া উচিত। তা না হলে যে হারে দেশে বনভূমি কমে আসছে, তাতে চিত্রা হরিণ একদিন সত্যি সত্যিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, খামারের অনুমোদনের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া উচিত। কারণ প্রাণিসম্পদ বিভাগের চিকিৎসকরা হরিণের রোগ-বালাই সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না।
আবার একটা হরিণ ধরার জন্য গাজীপুর নয়তো ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে লোক আনতে হয়। সেক্ষেত্রে এসব সমস্যার সমাধানে অঞ্চলভিত্তিক জনবল নিয়োগ দেওয়া উচিত। সবকিছু মিলিয়ে হরিণ যাতে সবাই পালন করতে পারে সেজন্য নীতিমালা শিথিল করা, ট্যাক্স কমানো এবং লাইসেন্স গণহারে দেওয়া উচিত বলেও তিনি মনে করছেন। প্রানীবিজ্ঞানী ড.অধ্যাপক গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, কুকুর-ছাগল-গরু সবকিছুই সভ্যতার বিবর্তনে একটি নিয়মের মধ্যে থেকে আজ পোষ্য ও গৃহপালিত। তেমনি হরিণ যদি পোষ মানে সেটা অবশ্যই ভালো।
তবে এর আগে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সুষ্ঠ পরিকল্পনার প্রয়োজন। হুট করেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া যাবেনা। এজন্য বিস্তর গবেষণা, আলোচনা ও সময়ের প্রয়োজন। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হরিণ পালন কিংবা খামার করার বিধিবিধান এখন অনেক সহজ করা হয়েছে।
Design and Developed By Sarjan Faraby