নিজস্ব প্রতিবেদক :: র্যাবের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভি*যোগ করবেন ঝালকাঠির পা হারানো লিমন
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির লিমন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করবেন। মামলায় দায়ী র্যাব কর্মকর্তা ও সদস্যদের আসামি করা হবে।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ বলেন, দুপুর ১টায় মুহাম্মদ লিমন হোসেন ট্রাইব্যুনালে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন।এর আগে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠিতে ছয় র্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনও (পিবিআই) চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। পিবিআইয়ের সেই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে লিমনের মা হেনোয়রা বেগমের নারাজি আবেদন গ্রহণ করেছেন আদালত। মামলাটি পুনঃ তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
চলতি বছরের ২৮ নভেম্বর ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক এ এইচ এম ইমরানুর রহমান নারাজি আবেদন শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। হেনোয়রা বেগমের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) নিয়োজিত আইনজীবী আক্কাস সিকদার। লিমনের মা ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর এই নারাজি আবেদন করেছিলেন।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বরিশাল র্যাব-৮-এর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এ সময় র্যাবের গুলিতে তৎকালীন কলেজছাত্র লিমন হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়। তখন লিমনের বয়স ছিল ১৬ বছর ৩ মাস। পরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করে লিমনের বাঁ পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলেন। এ কারণে লিমন এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি।এ ঘটনায় লিমনের মা বাদী হয়ে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল র্যাব-৮-এর তৎকালীন ডিএডি লুৎফর রহমান, করপোরাল মাজহারুল ইসলাম, মো. আবদুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক প্রহ্লাদ চন্দ ও সৈনিক কার্তিক কুমার বিশ্বাসের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও ছয় র্যাব সদস্যের নামে ঝালকাঠির আদালতে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। মামলাটি রাজাপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল হালিম তালুকদার তদন্ত করেন।
তিনি ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে র্যাব সদস্যদের অব্যাহতির সুপারিশ করেন। লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতে নারাজি দাখিল করেন। আদালত ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তার নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন। নারাজি খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ রিভিশন দায়ের করেন হেনোয়ারা বেগম।
২০১৮ সালের ১ এপ্রিল অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এস কে এম তোফায়েল হাসান রিভিশন মঞ্জুর করেন। রিভিশন মঞ্জুর হওয়ার পর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সেলিম রেজা মামলাটি তদন্তের জন্য ২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল পিবিআইকে নির্দেশ দেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পিবিআই প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম ২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থানা-পুলিশের মতো আদালতে আবারও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে পিবিআই উল্লেখ করে, লিমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা সত্য, তবে কারা তাকে গুলি করেছে, তার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতে সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে। এ কারণে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এ চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম আদালতে ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর নারাজি দাখিল করেন। লিমনের মায়ের দাবি, তার ছেলে কোনো সন্ত্রাসী ছিল না। একটি ভালো ছেলেকে র্যাব গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। এ ঘটনার তিনি সুষ্ঠু ও সঠিক বিচার দাবি করেন।
র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক পা হারানো লিমন হোসেন ২০১৩ সালে এইচএসসি, ২০১৮ সালে আইন বিষয়ে এলএলবি (স্নাতক), ২০১৯ সালে এলএলএম (স্নাতকোত্তর) পাস করেন। বর্তমানে তার বয়স ২৯ বছর। ২০২০ সালে সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন লিমন। ২০২২ সালে বিয়ে করেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার এক তরুণীকে।
এর আগে লিমন হোসেন বলেছিলেন, ‘র্যাব অন্যায়ভাবে আমাকে গুলি করে পঙ্গু করেছে। আমি অনেক কষ্ট করে মানুষের ভালোবাসায় পড়ালেখা শেষ করেছি ঠিকই, কিন্তু আমার পা হারানোর কষ্ট ভুলতে পারছি না। যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন যারা আমাকে পঙ্গু করেছে, তাদের বিচার দাবি করবো।’
২০১১ সালে ঘটনার পর লিমনকে সন্ত্রাসী দাবি করে র্যাব লিমনসহ আটজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে পৃথক যে দুটি মামলা করেছিল, সেই দুটি মামলাতেই লিমনসহ সব আসামি আদালত থেকে ২০১৮ সালে নির্দোষ প্রমাণিত হন। ঘটনার শুরু থেকে লিমনকে আইনি সহায়তা দিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং ঝালকাঠির কয়েকজন আইনজীবী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রে নিয়োজিত লিমনের মায়ের আইনজীবী আক্কাস সিকদার ওই সময় বলেন, ঘটনার পর রাজাপুর থানা-পুলিশ লিমন হত্যাচেষ্টা মামলা তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে র্যাব সদস্যদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয় এবং লিমনসহ পুরো পরিবারকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে। অপরদিকে পিবিআই প্রায় চার বছর তদন্ত করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ঘটনা সত্য বলে দাখিল করে। পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে লিমনকে একজন শান্তশিষ্ট ছাত্র হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, র্যাব ও সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির মধ্যে লিমন গুলিবিদ্ধ হয়েছে ঠিকই; কিন্তু কে তাকে গুলি করেছে তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।লিমন হোসেন বলেন, ‘আসলে পিবিআই তদন্ত করে আসল ঘটনা জানতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের তদবিরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে আমার কাছে প্রতিবেদনটি সত্যের কাছাকাছি মনে হয়েছে। কোনো সংস্থার কাছ থেকে আমরা ন্যায়বিচার না পেলেও হাইকোর্ট থেকে একদিন ন্যায়বিচার ঠিকই পাবো।’