নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশালের ঐতিহ্যবাহী হিমনীড় থেকে স্বেতপদ্ম বিনাশ : তদন্ত শুরু।
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ’র কতিপয় বিবেকহীন কর্মকর্তার হীনস্বার্থে ঐতিহ্যবাহী হিমনীড় এর পদ্মপুকুর থেকে শ্বেতপদ্ম উৎপাটন করে মেরে ফেলার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। গত ২৪ অক্টোবর ডিজাইন এন্ড মনিটরিং বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সরেজমিনে তদন্ত শুরু হয়েছে প্রায় একমাস পর। গত ২১ নভেম্বর তদন্ত কমিটির প্রধান সহ অন্যান্য সদস্যরা সরেজমিনে তদন্ত করে গেছেন।
কমিটিতে বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, অর্থ বিভাগের উপ-পরিচালক সাইফুর রহমান এবং বন্দর ও পরিবহন বিভাগের বরিশালের উপ-পরিচালক আবদুর রাজ্জাক সদস্য হিসেবে রয়েছেন।
শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী হিমনীড় এর পদ্মপুকুর থেকে ২০১৯ সালে মাছ ধরার নামে পদ্মফুলের বংশ বিনাশ করা হয়। এর বছর দুয়েকের মধ্যে আবারও স্বেতপদ্মরা আপন মহিমায় ফিরে এসেছিল।
কিন্তু গতবছর পদ্মপুকুরের মাঝে কর্মকর্তাদের শ্রান্তি বিনোদনের লক্ষে একটি খোলা ঘোলঘর নির্মান সহ পদ্ম ফুলের বংশ বিনাশ করা হয়। এ ঘর নির্মানে সরকারের কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ও হয়েছে। তবে কি উদ্দেশ্যে পুকুরটি থেকে পদ্ম ফুলের মূল উৎপাটন করা হয়েছে, এখন আর সে বিষয়ে মুখে কেউ কথা বলছেন না।
হিমনীড় এর পদ্ম পুকুর থেকে শ্বেতপদ্ম নির্মূলের বিষয়টি নিয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর সংবাদ প্রকাশ হলে কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। পরবর্তিতে চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বরিশাল সফরকালে শ্বেতপদ্মের খোঁজ খবর নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা সরেজমিনে পুকুরটি পরিদর্শন করে স্থানীয় প্রকৌশল বিভাগের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্য গ্রহণ করেছেন। পাশাপাশি পুকুরটির মাটি ও পানি পরীক্ষার জন্য কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করা হয়েছে।
একাধিক সূত্র বলছে-রাতের আঁধারে হিমনীড় এর পুকুরটি থেকে মাছ ধরার জন্য পদ্মফুলের বংশ বিনাশ করা হয়েছে। কিন্তু বিবেকহীন এ কর্মকান্ডের পরেও কর্তৃপক্ষের বিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে সাফাই গেয়েছিলেন যে পুকুরটি থেকে প্রকৃতিগত কারণেই পদ্মফুলের বংশ বিনাশ হয়েছে। অথচ তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে রাতের আঁধারে পুকুরটি থেকে মাছ ধরার লক্ষ্যেই শ্বেতপদ্মের বংশ নির্মূল করা হয়েছে। এমনকি পুকুরটি থেকে অবৈধভাবে আহরণ করা সরকারি মাছ নির্বাহী প্রকৌশলী সহ আরো কয়েকজন কর্মচারী লোপাট করেছেন বলেও কমিটির কাছে প্রমানিত হয়েছে। শুধুমাত্র সরকারি পুকুরের মাছ খাবার লোভেই ঐতিহ্যবাহী একটি সরকারি পুকুর থেকে দীর্ঘদিনের নয়নাভিরাম পদ্ম ফুলের বংশ নির্মূল করার বিষয়টি কমিটির কাছে প্রমানিত হয়েছে বলে জানা গেছে। চলতি সপ্তাহের শেষ ভাগেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর মাটি ও পানি পরীক্ষার ফলাফলের ওপরই প্রতিবেদন প্রস্তুত ও দাখিলের বিষয়টি নির্ভরশীল বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
উল্লেখ্য বৃটিশÑভারত যুগে তৎকালীন নৌ ও রেল বানিজ্য প্রতিষ্ঠান, ‘অইজিএন-আরএসএন কোম্পানী’র পূর্ব বাংলার সদর দপ্তর ছিল বরিশালের এই হিমনীড়। সে সময় একতলা চুন-সুরকীর ভবনটির পশ্চিম-দক্ষিণ কোনে নির্মান করা হয় কাঠের পাটাতনের ওপর টালির ঘর। ‘চাড়ার বাংলো’ খ্যাত ঐ দ্বিতল ঘরটি ছিল কোম্পানীর ম্যনেজারের বাসভবন। আর এ দুটি ভবনের দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে খনন করা হয়েছিল একটি পুকুর। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে এখানে ‘পাকিস্তান রিভার স্টিমার্স-পিআরএস’এর নৌ নির্র্মান কারখানার অফিসের কার্যক্রম পরিচিালিত হতো। এবং ম্যানেজারের বাসভবনও ছিল এখানে। ১৯৫৮ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরেটি-ইপিআইডব্লিউটিএ’ গঠনের পরে সরকারি নির্দেশে বরিশালের নৌ কারখানা পিআরএস থেকে আইডব্লিউটিএ’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। ফলে হিমনীড়’র একতলা দালানে ম্যানেজারের বাসভবন আর কাঠের চাড়ার বাংলোতে স্থাপন করা হয় পরিদর্শন বাংলো।
১৯৬৪ সালে এখানে কর্মরত একজন ব্যবস্থাপকের আপ্রাণ চেষ্টায় হিমনীড় সংলগ্ন পুকুরটিতে সফলভাবে পদ্ম ফুলের আবাদ সম্পন্ন হয়। সেই থেকে ২০১৯ সালের শেষভাগ পর্যন্ত এ পুকরটি পদ্মফুলে ঢেকে ছিল। কিন্তু আগাছা পরিস্কারের নামে সে সময়ও একবার পুকুরটির পদ্ম ফুলের বংশকে নির্বংশ করার চেষ্টা করে একটি মহল।
একইভাবে গতবছরের শেষভাগে পুনরায় পদ্মপুকুরের মাঝে একটি ঘর নির্মান ও মাছ চাষের নামে শ্বেতপদ্মের বংশ বিনাশ সহ মাছ লুট করেন বিআইডব্লিউটিএ‘র কতিপয় কর্মকর্তারা।