নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশালে মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের ‘অলআউট কর্মসূচি’
ভরা বসন্তকালেও মশার অস্বাভাবিক বিস্তারে রাতদিন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে বরিশাল নগরবাসীর জীবন। এমন পরিস্থিতিতে মশার দাপট কমাতে ‘অলআউট কর্মসূচি’ গ্রহণ করেছে সিটি করপোরেশন। মঙ্গলবার দুপুর থেকে দুটি ওয়ার্ডে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে নগরের সব ওয়ার্ডে সাত দিনের মধ্যে অলআউট কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। নগরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরিশাল অঞ্চলে কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেড়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের তৎপরতা আগের চেয়ে বাড়ানো হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
বাসিন্দারা বলছেন, ফগার মেশিন হাতে মশকনিধনকর্মীদের প্রতিনিয়ত ছুটে চলা, বিভিন্ন এলাকার ঝোপ ও বদ্ধ নালায় হ্যান্ড স্প্রে করার দৃশ্য চোখে পড়লেও এসব কোনো কাজে আসছে না। নগরের কয়েকজন বাসিন্দা গত কয়েক বছরের মশার উপদ্রবের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জানান, আগে নভেম্বর-ডিসেম্বরে মশার উপদ্রব বেশি থাকলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।
এবার মার্চেও সর্বত্র মশার ব্যাপক বিস্তৃতি দেখা যাচ্ছে। দিনেও থাকছে মশার দাপট। আর সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তবে বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, মশা নিধনে আগের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর বর্তমান সিটি করপোরেশন।
তারপরও মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এবার সিটি করপোরেশন অলআউট কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ৫৮ বর্গমাইল আয়তনের বরিশাল নগরে বর্তমানে ছয় লাখের বেশি মানুষের বসবাস। অলআউট কর্মসূচির আওতায় মঙ্গলবার দুপুর থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১০ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে একযোগে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হয়েছে। সাত দিনব্যাপী চলবে এই কর্মসূচি।
এর মধ্যে যাঁরা নিজ নিজ বাসস্থান পরিষ্কার রাখবেন না, তাঁদের জরিমানার মুখে পড়তে হতে পারে বলেও জানিয়েছে করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বরিশালের ভেতর দিয়ে ২২টি খাল প্রবাহিত হয়েছে। একসময় বর্ষাকালে এসব খালে পানি প্রবাহিত হলেও এখন অনেক জায়গায় খাল শুকিয়ে নর্দমায় পরিণত হয়েছে।
পাশাপাশি জলাবদ্ধতা, ঝোপঝাড় ও অপরিচ্ছন্নতার কারণে মশার বংশবিস্তার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ওষুধ ছিটিয়েও তেমন একটা সুফল মিলছে না। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস জানান, প্রতিদিন ২৮টি ফগার মেশিনের মাধ্যমে ২৮০ লিটার এডাল্টিসাইড (বড় মশা মারার ওষুধ) প্রয়োগ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া চারটি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইড (মশার লার্ভা ধ্বংসের ওষুধ) ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে চারদিকে মশার উপযোগী পরিবেশ থাকায় এই সমস্যার সমাধান কঠিন হয়ে পড়ছে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. মনজুরুল হক শুভ্র বলেন, মশার উপদ্রব রোধে সিটি করপোরেশন একটি ‘পাইলট প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে মশা নিধনের কাজ শুরু হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ওয়ার্ডেও সম্প্রসারিত হবে।
এ ছাড়া যাঁদের বাড়িঘর অপরিচ্ছন্ন পাওয়া যাবে, তাঁদের নোটিশ দেওয়া হবে। গত সোমবার ১০ জনকে এ ধরনের নোটিশ পাঠানো হয়েছে। ধাপে ধাপে অন্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বরিশাল নগরের আমির কুটির এলাকার বাসিন্দা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগের সমন্বয়ক রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বরিশাল নগরে আগে ২২টি খাল প্রবহমান ছিল, এসব খালের একটিও এখন সচল নেই।
এসব খাল উদ্ধার করে প্রবাহ নিশ্চিত করতে না পারলে এবং ড্রেনের পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা সচল করতে না পারলে মশক নিধনের যেকোনো কার্যক্রম সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ ছাড়া নগরের অধিকাংশ এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি, ইট-পাথর-বালু সড়কে স্তূপ করে রাখাসহ নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র রাখায় তা জনভোগান্তির পাশাপাশি মশা-মাছির উৎপত্তিস্থলে পরিণত হয়েছে।
এ জন্য সিটি করপোরেশনকে উদ্যোগ নিতে হবে। মশার বিস্তারে বরিশাল নগরসহ সর্বত্র বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এতে নগরবাসীর মধ্যে ছড়াচ্ছে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর বরিশাল নগরসহ বিভাগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন ৮ হাজার ৪৫৭ রোগী। এর মধ্যে মারা গেছেন ৫৮ জন।
চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২৯০ জন। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে বিভাগে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকত। কিন্তু গত বছর থেকে এই বিভাগে সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকছে। এটা উদ্বেগজনক। এ জন্য মশার বিস্তাররোধে ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।