নিউজ ডেস্ক : ছাত্রদলের হাত ধরে রাজনীতিতে তাঁর আগমন। পরে জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক এক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। একসময় কর্মকর্তা থেকে সরাসরি জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মন্ত্রীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির ফলে জাতীয় পার্টি ছেড়ে পরে ‘সোনার নৌকা’ নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দেখতে দেখতে হয়ে যান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। যে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন তাঁকেই হারিয়ে সংসদ সদস্য হন ২০২৪ সালে। বারবার ডিগবাজি দিয়ে রাজনীতিতে নিজের রং পাল্টানো ব্যক্তি হচ্ছেন মহিউদ্দীন মহারাজ। তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও ছিল। বাইরে ছিলেন জনপ্রতিনিধি আর ভেতরে ঠিকাদার।
পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক তিনি। তাঁর ভাই মিরাজুল ইসলাম ভাণ্ডারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। সেজো ভাই মো. সামসুদ্দিন একই উপজেলার তেলিখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। ছোট ভাই মো. সালাউদ্দিনও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিন ভাই জনপ্রতিনিধি হলেও ঠিকাদারিই ছিল তাঁদের মূল পেশা। শুধু মহারাজ আর তাঁর তিন ভাই শুধু নন, এক ভাইয়ের (মিরাজুল) স্ত্রী শামীমা আক্তারও রাজনীতির পাশাপাশি প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। এই ঠিকাদার পরিবারের পেটেই গেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডির অধীনে ১২৮ সেতু নির্মাণের প্রায় ২৩৬ কোটি টাকা।
সেতুগুলো কাগজে আছে বাস্তবে নেই। জাল কাগজপত্র দেখিয়ে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন ঠিকাদার মহারাজ ও তাঁর ভাই-ভাবি। জানা গেছে, সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দীন মহারাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেসার্স হরিণপালা ট্রেডার্স, তাঁর ভাই মিরাজুল ইসলামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইফতি ইটিসিএল (প্রা.) লিমিটেড ও সাউথ বাংলা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মিরাজুলের স্ত্রী শামীমা আক্তারের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শিমু এন্টারপ্রাইজ, মহারাজের আরেক ভাই সামসুদ্দিনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তেলিখালী কনস্ট্রাকশন এবং ছোট ভাই মো. সালাউদ্দিনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ঈশান এন্টারপ্রাইজ। এই ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নামে ১২৮টি সেতুর কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল।
এই ঠিকাদার পরিবারের সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা আওয়ামী লীগের দাপট দেখিয়ে ১২৮টি সেতু নির্মাণ না করেই পুরো অর্থ তুলে নিয়েছেন। এলজিইডির সংশ্লিষ্ট পিরোজপুর সদর, ভাণ্ডারিয়া ও নেছারাবাদ উপজেলা প্রকৌশলীর নামে ভুয়া বিল প্রস্তুত করে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে অর্থ তুলে নিয়েছেন। এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) মহারাজ পরিবারের মহারাজসহ পাঁচজন ঠিকাদার ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ এবং হিসাবরক্ষণ অফিসের ২৩ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে। তার মধ্যে পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে মহারাজ পরিবারের অভিযুক্ত পাঁচজনসহ ১৮ আসামি পলাতক রয়েছে। দুদকের উপপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এলজিইডির অধীনে আয়রন সেতু পুনর্নির্মাণ/পুনর্বাসন প্রকল্প-আইবিআরপির ১২৮টি স্কিমের কাজ না করেই আসামিরা যোগসাজশে প্রায় ২৩৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ঘটনায় ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
২৩৬ কোটি লোপাট : পিরোজপুর সদরের কদমতলা ইউনিয়নের পোরগোলা মাধ্যমিক স্কুল থেকে বাঘমারা আবাসন সড়কে যাতায়াতের জন্য বাঘমারা খালের ওপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৯৬ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণের প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয় ১০ কোটি ৩২ লাখ ৫৬৪ টাকা। মহারাজের ভাই মিরাজুল ইসলামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইফতি ইটিসিএল (প্রা.) লিমিটেড ৯ কোটি ২৮ লাখ ৪০ হাজার ৫০৭ টাকা চুক্তি মূল্যে সেতু নির্মাণের কাজ পায়। এলজিইডির সদর উপজেলা প্রকৌশলী হরষিত সরকারের স্বাক্ষর জাল করে হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অর্থ তুলে নেওয়া হয়। তবে বাস্তবে সেতুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। একইভাবে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে পিরোজপুরের শুধু ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় ১২৫টি স্কিমের মাধ্যমে ২৬৯ কোটি ২৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠাগুলো উত্তোলন করে নিয়ে যায়। স্থানীয় এলজিইডি অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে এসংক্রান্ত কাগজপত্র রক্ষিত ছিল না। এ ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার কাজটি করা হয়। এমনকি প্রকল্পের প্যাকেজের নম্বর পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। দপ্তরের কাজের পরিমাপ বইতেও কোনো তথ্য খুঁজে পায়নি দুদক। এ অবস্থায় দুদকের উপপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ১৫ এপ্রিল দুদকের পিরোজপুর জেলা সমন্বিত কার্যালয়ে মামলা দায়ের করেন।
১২৫ কাগুজে সেতু ভাণ্ডারিয়ায় : অনুসন্ধানে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় (বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি ও বরগুনা) নদী ও খালের ওপর অনেক লোহার সেতু করা হয়। ২০১৮ সালে দুই হাজার ৪৯টি লোহার সেতু পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ‘দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আয়রন ব্রিজ পুনর্নির্মাণ/পুনর্বাসন’ শিরোনামের প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এলজিইডি থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সেতুগুলোর দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৩৫ মিটার। পরবর্তীতে দৈর্ঘ্য আরো বাড়ানো হয়। ২০২১ সালে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দুই হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় এর মধ্যে সেতুর কাজ শেষ হয়েছে এক হাজার ১২৯টি, চলমান আছে ৬৪৮টি। জমি অধিগ্রহণ, ঠিকাদারের সঙ্গে সমস্যা, আইনি জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে ৮২টি সেতুর কাজ শেষ হয়নি। ১৯০টি সেতু নির্মাণ প্রকল্প থেকে সম্প্রতি বাতিল করা হয়েছে।
মূলত পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত গ্রামেও থাকবে শহরের সুবিধা শীর্ষক রূপকল্পের আলোকে এ প্রকল্প নেওয়া হয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আয়রন ব্রিজ পুনর্নির্মাণ/পুনর্বাসন প্রকল্প-আইবিআরপির উদ্দেশ্য হলো—খাল ও জলাধারগুলো সচল রাখা এবং গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। সেই লক্ষ্যে আশির দশকে নির্মিত জরাজীর্ণ লোহার পুলের স্থলে আরসিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ ও পুনঃ সংস্কার। এই উদ্যোগ এখন অনিয়মের উদাহরণ হয়ে উঠছে। প্রকল্পের আওতায় পিরোজপুরের শুধু ভাণ্ডারিয়া উপজেলাতেই ১২৫টি কাগুজে সেতু নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়া পিরোজপুর সদরে দুটি এবং নেছারাবাদে একটি সেতুর অনুমতি ছিল।
বাইরে জনপ্রতিনিধি, ভেতরে ঠিকাদারি : প্রথিতযশা সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় রাজনীতিতে ছিলেন আলোচিত। ১৯৯৬ সালে তখনকার জাপা নেতা মঞ্জুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন মহারাজ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী সিলেট-১৭ আসনের এমপি এনামুল হক মোস্তফার ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মঞ্জুর সঙ্গে মহারাজের দূরত্ব তৈরি হতে বেশি সময় লাগেনি। ২০১৪ সালে ভোটারহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তখনকার এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ কে এম আউয়ালকে স্বর্ণের নৌকা উপহার দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন মহারাজ। এর পরই মহারাজ পিরোজপুরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা চালান। ২০১৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অর্থের দাপটে পিরোজপুর জেলায় সবচেয়ে প্রভাবশালী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন তিনি।
২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-২ (ভাণ্ডারিয়া-স্বরূপকাঠি-কাউখালী) আসনে মহারাজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সাতবারের এমপি নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে হারান। গত উপজেলা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত না হতে আওয়ামী লীগের কঠোর নির্দেশনা ছিল। কিন্তু মহারাজ ভাণ্ডারিয়ায় ভাই মিরাজকে উপজেলা চেয়ারম্যান করিয়ে নেন কৌশলে। তার আগের উপজেলা নির্বাচনেও মিরাজ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেজো ভাই সামসুদ্দিন তেলিখালী ইউনিয়নে দুবার চেয়ারম্যান হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই মহারাজ পরিবারের সদস্যরা আত্মগোপনে আছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এলজিইডির পিরোজপুর অফিসে নির্বাহী প্রকৌশলীকে পাওয়া যায়নি। মামলা হওয়ার পর থেকে ওই দপ্তরে গিয়ে বক্তব্য দিতে সম্মত কাউকে পাওয়া যায়নি।
তথ্যসূত্র :কালের কণ্ঠ।