অনুসন্ধানী রিপোর্ট :: ফ্যাসিবাদের দোসর পটুয়াখালীর বাউফলের ১৪ নং নওমালা ইউনিয়ন বটকাজল গ্রামের নগরের হাট নামক স্থানের পল্লী চিকিৎসক আব্দুল খালেক বিশ্বাসের তিন পুত্রের দেশ ত্যাগের আশঙ্কা করা হচ্ছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিভিন্ন জায়গায় হামলা-মামলার অভিযোগ এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলের ১৬ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষ এবং ভিন্নমতের মানুষদের উপরে চরম জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা, দিন-দুপুরে আগুন দিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া এবং ব্যাপক চাঁদাবাজী, ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, সরকারী সম্পদ আত্মসাৎ, মানি লন্ডারিংসহ বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমানোর গুঞ্জন উঠেছে এই তিন সহোদরের বিরুদ্ধে। সুযোগ বুঝে তারা যেকোনো সময় দেশ ছাড়তে পারেন।
একদিকে জামিনের চেষ্টা, অন্যদিকে বিদেশে পালানোর প্রস্তুতি চলছে বলে বিশ্বাস পরিবারের ঘনিষ্ট এবং বিশ্বস্ত একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। উল্লেখ্য, মোঃ কামাল বিশ্বাস বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক, নওমালা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও নওমালা ইউনিয়নের বরখাস্তকৃত চেয়ারম্যান। মোঃ আনিসুর রহমান বিশ্বাস অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং মশিউর রহমান লাভলু বিশ্বাস বিমান বাহিনীর সাবেক উইং কমান্ডার।
সরেজমিনে জানা যায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার (০৫ এপ্রিল, ২০২৫) সন্ধ্যায় পটুয়াখালীর কালিকাপুর এলাকা থেকে আত্মগোপনে থাকা দুর্নীতিবাজ ইউপি চেয়ারম্যান কামাল বিশ্বাসকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। পরে বাউফল থানায় হস্তান্তর করা হয়। বাউফল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ কামাল হোসেন সাংবাদিকদের কাছে বিষ্ফোরক মামলায় কামাল বিশ্বাসের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন বলে জানান। রোববার (০৬ এপ্রিল) সেই মামলায় কামালকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হলে বিচারক তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন।
বরখাস্তকৃত কামালকে পরপর তিন বার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন বিজ্ঞ আদালত। নামপ্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আইনজীবী আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, শ্রীঘরে বসবাসকৃত কামাল হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ভাইদেরসহ বিদেশ পাড়ি জমাতে পারেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন প্রধান কার্যালয়ে আয় বহির্ভূত প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগ দুদকের হাতে। নথিতে উল্লেখ করা হয় একজন দুর্নীতিবাজ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আনিছুর রহমান বিশ্বাস দেশের শত্রু। তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে ৯৬ কোটি ৬৬ লক্ষ টাকা আয় বর্হিভূত সম্পদের অধিকারী।
প্রকাশ থাকে যে, সাবেক চিপ হুইপ আ স ম ফিরোজ (পটুয়াখালী-বাউফল ২, সংসদীয় আসন নং-১১৬) এর সাথে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকার কারণে বিভিন্ন সময় তাঁর দ্বারা বিভিন্ন রাজনৈতিক তদবির করে যত আয় করেছেন তার সিংহ ভাগ উভয়ের মধ্যে বন্টন করে নিতেন।
অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আনিসুর রহমান বিশ্বাস দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং মানি লন্ডারিং করে অজস্র টাকা পাঁচার করেছেন। রাজধানীর শেল্টার, কাজীসাল ১/১ কল্যাণপুর প্রধান সড়ক, মিরপুর, এই ফ্লাটে জজ সাহেবের ভাই বোনের নামে পাঁচটি সুসজ্জিত ফ্ল্যাট রয়েছে।
আরো জানা গেছে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে ‘বিশ্বাস পরিবার’ বহুমুখী অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সরকারি অর্থ লুটপাট করে কাড়িকাড়ি টাকা কামিয়েছেন, যা দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। এছাড়াও নৌকাকে পুঁজি করে স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে নিরাপদ মানুষকে মারধর-হয়রানিসহ জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা করেছেন।
দুদকের নথিতে সম্পদের ফিরিস্তি :
০১. তিনি গত চার মাস পূর্বে মিরপুর ডিওএইচএস সেনা কল্যাণ মার্কেটের পিছনে রোড নম্বর ৩২ বাসা নম্বর। ১১৩৪, (২৪৫০) স্কয়ারফিটের একটি আধুনিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ক্রয় করেন, যার মূল্য ৮ কোটি টাকা।
০২. ইসিবি চত্বরে তার ছোট ভাইয়ের নামে বিমান বাহিনীর সাবেক উইং কমান্ডার খ ম মশিউর রহমান লাভলুর নামে দশ কাঠার একটি প্লট রয়েছে যার মূল্য ২০ কোটি টাকা।
০৩. তার আরেক ছোট ভাই বর্তমানে ইউপি চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট কামাল হোসেন বিশ্বাসের নামে পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার একটি প্লট ক্রয় করেছেন, যার মূল্য ৯ কোটি টাকা।
০৪. জেলা পটুয়াখালী, থানা বাউফল, ইউনিয়ন নওমালা, নগরের হাটে বিভিন্ন নামে তাদের ১০টি বাড়ি রয়েছে যার মধ্যে একটি টিনশেড বাকিগুলো তিন, চার ও পাঁচ তলা বিশিষ্ট বাড়ি, যার মূল্য ১৮ কোটি টাকা।
০৫. ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে নগরহাট এলাকায় সরকারি খাস জমি ও নওমালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে (রূপকথা) নামক বিশাল আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন, যার জে এল নম্বর ১১৬, দাগ নম্বর ৫১৯৭, মৌজা-বটকাজল, নগরেরহাট এলাকায় পঁচিশ শতাংশ জায়গা দখল করে বসত বাড়ি ও ফার্মেসি তৈরি করেন, যেটা বর্তমান তার ছোট ভাই আতিকুর রহমান মামুন বিশ্বাস পরিচালনা করছেন। যার মূল্য ৭ কোটি টাকা।
০৬. জেলা পটুয়াখালী, থানা বাউফল, ইউনিয়ন নওমালা, পোষ্ট নগরেরহাট ৫২১৩ নম্বর দাগে ১০ শতাংশ জমি কিনে পাঁচ তলা ভবন তৈরি করেছেন।
০৭. জেলা পটুয়াখালী, থানা বাউফল, ইউনিয়ন নওমালা, পোষ্ট নগরেরহাট ৫২৬৯ নং দাগে জমি ক্রয় করে তিন তলা বিশিষ্ট দুইটি বাড়ি ও একটি টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করেন, যার জে এল নম্বর ১১৮ এবং ৫ নম্বার দাগে ভাঙ্গা ব্রিজ এলাকার স্ব-মিলসহ এলাকার ৭০ শতাংশ জমি ক্রয় করেন, যার মূল্য ৬ কোটি।
০৮. পটুয়াখালী টু কালাইয়া হাইওয়ে প্রধান সড়কের পাশে নগরের হাট এলাকায় গ্রামীণ ব্যাংকের উভয় পাশে ২৫৮ ২৬৭ ২৭৯ নম্বর দাগে দুইটি মার্কেট তৈরি করেন এবং ৩০৩ নম্বর দাগ একটি টিনশেড ঘর তৈরি করেন, যার মূল্য ১০ কোটি টাকা।
০৯. নগরের হাটে গ্রামীণ ব্যাংকের পেছনে রয়েছে ১৭৫ শতাংশ জমি যার মূল্য ১০ কোটি টাকা পটুয়াখালী সদর থানায় কলাতলা স্থান নামে তার রয়েছে দুটি আধুনিক ও ছয়তলা বিশিষ্ট বাড়ি যাতে তার ভাই বোনেরা বসবাস করেন এবং নিয়মিত ভাড়া পাচ্ছেন, যার মূল্য ৬ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা।
১০. ক্ষমতার অপব্যবহার করে সে তার বাবা আব্দুল খালেক বিশ্বাস এর মৃত্যুর ২০ বছর পরে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বের করেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত ভাতা হিসেবে ২০ হাজার টাকা জমা হয় আনিসুর রহমানের ব্যাংক একাউন্টে। যা বর্তমানে প্রায় ১৬ লক্ষ টাকার মত।
ভুক্তভোগী এবং এলাকাবাসী নামপ্রকাশ না করার শর্তে জানান, ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর বিশ্বাস পরিবার আত্মগোপনে থেকেও অফিস-আদালতে আনাগোনা অব্যাহত রেখেছে। দুদকের অভিযানের আতঙ্কে বিদেশে পাড়ি জমানোর গুঞ্জন রয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে। যা সুষ্ঠু তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল।