নিউজ ডেস্ক :: খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমানের বদলির আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে এবার নজিরবিহীন আন্দোলন শুরু করেছেন জুলাই আহতরা।
সোমবার (১১ আগস্ট) বিকেলে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন শেষে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
এর আগে সকালে খুমেক হাসপাতালে বিক্ষোভ করেছে জুলাই আহত ও সাধারণ রোগীরা। জুলাই আন্দোলনে আহত যোদ্ধারা অবিলম্বে দুর্নীতিগ্রস্ত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হাসপাতালের সেবার মান ফিরিয়ে আনতে নিরলস পরিশ্রম করা ডা. মিজানুর রহমানকে বদলির মাধ্যমে আওয়ামী চিকিৎসকদের পুনর্বাসন করতে চায় একটি চক্র। পরপর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসন থেকে দুজন জামায়াতপন্থি চিকিৎসককে সরিয়ে দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা পরিচালক ডা. মোহসীন আলী ফরাজী এবং সহকারী পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান মিজানকে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জুলাই আহত যোদ্ধা মো. বাদশা হোসেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, জুলাইয়ের অন্যতম সহযোগী মিজানুর রহমান স্যারকে বদলি করা হয়েছে। এটা শুনে আমরা জুলাই আহত যোদ্ধারা চরমভাবে ব্যথিত হই। বিগত কয়েক মাসে কেএমপি কমিশনার, খুলনা জেলা প্রশাসকের মতো ভালো কর্মকর্তাদের বদলি করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এরই ধারাবাহিকতায় খুলনা মেডিকেলের জুলাই আহতদের বন্ধুপ্রতীম ডাক্তার মিজানুর রহমানকে বদলি করার জন্য সমাজের একটি দুষ্টচক্র উঠেপড়ে লেগেছে।
জুলাই আহত যোদ্ধা খালিদ শামস প্রান্ত কালবেলাকে বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় একমাত্র মিজান স্যার জুলাইকে ধারণ করে আমাদের চিকিৎসা করেছে এবং আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেছে। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের চিকিৎসা করেছেন। এমনকি অনেকের এখনও চিকিৎসা চলছে। তারা মিজান স্যারের অধীনে চিকিৎসাধীন। এমন অবস্থায় মিজান স্যার চলে গেলে আমাদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে খুলনার অধিকাংশ জুলাই আহত গেজেটেড যোদ্ধারা ড. মিজানুর রহমানের পক্ষে অবস্থান করার ঘোষণা দেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন- জুলাই আহত যোদ্ধা হুজাইফা, সিরাজুল ইসলাম, মারুফ প্রমুখ।
যে ঘটনায় বদলি করা হয় ডা. মিজানকে : জানা গেছে, গত ১১ জুলাই নির্ধারিত সফরসূচি অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সাইদুর রহমান গত ১১ জুলাই খুলনা বিশেষায়িত হাসপাতাল ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। বিকেলে তিনি নগরীর সোনাডাঙ্গায় নবনির্মিত বেসরকারি সংস্থার ডায়ালাইসিস সেন্টারের উদ্বোধন এবং সন্ধ্যায় হোটেল ওয়েস্টার্ন ইন-এ স্বাস্থ্য সেবায় বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সম্পৃক্ততা শীর্ষক মতবিনিময় সভায় যোগ দেন। যে বেসরকারি সংস্থার আয়োজনে সেখানে তিনি যোগ দেন সেটি বিগত দিনের একটি বিতর্কিত এনজিও হিসেবেই পরিচিত ছিল। এ ছাড়া ওই অনুষ্ঠানে কোনো সরকারি প্রচার মাধ্যমকেও জানানো হয়নি। জানানো হয়নি প্রথম সারির অনেক গণমাধ্যমকেও।
জানা গেছে, খুলনা বিশেষায়িত হাসপাতাল পরিদর্শনকালে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ খুলনা জেলার বর্তমান কোষাধ্যক্ষ ডা. বিষ্ণু পদ সাহাকে কেন কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না এজন্য হাসপাতালের পরিচালককে ভর্ৎসনা করেন স্বাস্থ্য সচিবের সফরসঙ্গী হিসেবে আসা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর। তখন পাশে ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সাইদুর রহমান।
অথচ ডা. বিষ্ণুপদ সাহা খুলনা মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাকালীন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন। জুলাই আন্দোলনে শান্তি সমাবেশের নামে ছাত্রদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ডা. বিষ্ণুপদ সাহা। হাসিনা সরকারের পতনের পর গুরুত্বপূর্ণ স্বাচিপ নেতাকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব প্রদানের জন্য চাপ দেওয়া নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে সাধারণ চিকিৎসকদের মধ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনার একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সফরের সময় পরিচালক অসুস্থতাজনিত ছুটিতে থাকায় একাই সচিবের সফরের সব কিছু সামলাতে হয় ডা. মিজানকে। ওই সময় খুলনার ঊর্ধ্বতন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিজানকে সচিবের গাড়িতে তেল ঢুকিয়ে দিতে বলেন। ওই কর্মকর্তা একই দিনে সচিবের সফরসঙ্গী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের গাড়িতে তেল ঢুকিয়ে দেন। আগে কখনও এমন পরিস্থিতির সামলানোর অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি তেল কেনার জন্য পাঁচ হাজার টাকার একটি খাম সচিবের ব্যক্তিগত সহকারীর হাতে দেন। এতেই বাধে বিপত্তি। ফলে রেগে গিয়ে সিনিয়র সচিব মো. সাইদুর রহমান চাকরি থেকে বরখাস্তের হুমকি দিয়ে ঢাকায় চলে যান।
চিকিৎসকরা বলেন, ডা. মিজান যদি ঘুষ দিতে চাইতো তাহলে জনসম্মুখে মাত্র ৫ হাজার টাকা দিতো না। বিষয়টি দৃষ্টিকটু হলেও তার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না বলে মনে করেন খুলনার অধিকাংশ চিকিৎসক।
সদ্য বদলি হওয়া ডা. মিজানুর রহমান বলেন, আমি সরকারি চাকরি করি। বাংলাদেশে যে কোনো জায়গায় বদলি হতে পারে সরকারি নিয়ম মেনে, আমার সেখানে যেতেও কোনো আপত্তি নেই। আমি নির্ধারিত সময়ে চলে যাবো। কিন্তু আমার মা, স্ত্রী-সন্তান খুলনায় একা থাকবে এটা একটা দুশ্চিন্তা।
ওই দিনের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ওই দিন আমি আমাদের সিনিয়র এক স্যারের কথায় একটি কাজ করেছি। সেটা হয়ত আমার ভুল। আমি আমার ভুল স্বীকার করে সচিব স্যারের সঙ্গে বদলি আদেশ পুনর্বিবেচনা করার জন্য আবেদন জানিয়েছি। স্যার যদি আমার অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আমার বদলি আদেশ পুনর্বিবেচনা করেন, তাহলে আমার জন্য ভালো হয়। আর যদি না হয় তাহলে চারশ কিলোমিটার দূরে বদলি হওয়া প্রতিষ্ঠানে যাবো চাকরি করবো। কারণ আমি অন্তর্বর্তী এই সরকারকে ধারণ করি। আমি একজন জুলাই যোদ্ধা। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিগত আওয়ামী আমলে বহু নিগ্রহের শিকার হয়েছি।
ডা. মিজান বলেন, আমি ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার আন্দোলনে সম্মুখ সারির একজন যোদ্ধা হিসেবে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিলাম। খুলনার জুলাই আন্দোলনে সব আহতরা আমাকে ভালোবাসেন। আমি নিজে তাদের সেবা দিয়েছি। যে কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাকে এই হাসপাতালে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছিল। আমি আমার সততা দিয়ে হাসপাতালটিকে সাজানোর জন্য পরিচালক মহোদয়কে সবসময় সহযোগিতা করেছি।
খুলনা জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আজ সন্ধ্যার দিকে কয়েকজন জুলাই আহতরা আমার সঙ্গে দেখা করেছে। তারা বলেছে- তারা ডা. মিজানের বদলির আদেশ প্রত্যাহার চায়। আমি তাদের বলেছি, সরকারি চাকরিতে বদলি নৈমিত্তিক ঘটনা। তারপরও তারা যেহেতু আসছে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাবো তাদের দাবির কথা।