নিউজ ডেস্ক :: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও সেনাবাহিনীর অভিযানে ঘণ্টাখানেক আগেই উদ্ধার হয় মাদক-অস্ত্র। গ্রেপ্তার হয় কয়েকজন মাদক কারবারি। তবে অভিযান শেষে ফিরতি যাত্রায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও সেনা সদস্যদের বহনকারী গাড়িগুলোর ইঞ্জিন চালুর পর চাকা ঘুরতে না ঘুরতেই স্বরূপে ফেরে মাদক কারবারিরা। হাতে হাতে গাঁজা, ইয়াবা ও হেরোইনের পুঁটলি নানান গলির মুখে ও ভেতরে শুরু হয় তাদের হাঁকডাক। মুহূর্তেই যেন মাদকের হাটে পরিণত হয় পুরো এলাকা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের গলিগুলো ঘুরে এমনই চিত্র দেখা যায়।
মাদক কারবারিদের মধ্যে থেমে থেকে সংঘর্ষের জেরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দফায় দফায় অভিযান পরিচালনা করছে জেনেভা ক্যাম্পে। প্রায় এক সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গত সোমবার ক্যাম্পের ভেতর শাহ আলম নামে এক মাদক কারবারিকে গলা কেটে হত্যার পর নড়েচড়ে বসেন পুলিশ, সেনাবাহিনী, র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা। ওই হত্যাকাণ্ডের দিন বিকেল থেকে কয়েক দফায় অভিযান চলে জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল দুপুরেও ক্যাম্পের ভেতরে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এদিন দুপুর ১টায় জেনেভা ক্যাম্পের হুমায়ুন রোডের সাত নম্বর সেক্টরের গলির মুখ থেকে শুরু হয় অভিযান, যা চলে প্রায় এক ঘণ্টা। ১টা ৫৮ মিনিটে অভিযান শেষ করে চলে যান তারা। এর ঠিক দুই মিনিটের মাথায় শুরু হয়ে যায় মাদক বিক্রি। হুমায়ুন রোডের ময়লার গলির সামনে চার-পাঁচজন কিশোর বয়সী ছেলেদের দুটো দলকে হাতে হাতে গাঁজা, ইয়াবা ও হেরোইনের পুঁটলি নিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেখা যায়। ময়লার গলির সামনে এক ক্রেতার সঙ্গে বাগবিতণ্ডা চলছিল মাদক কারবারিদের। দুপক্ষের মধ্যে বিতণ্ডার কারণ জানতে চাইলে সেই ক্রেতা বলেন, ‘ভাই আমি একশ ট্যাকার তামুক (গাঁজা) চাইছি, তারা দিছে বিশ টাকার তামুক। জিগাইছি, যে তামুক দিছেন—এইটা তো বিশ ট্যাকারও না। আমি তামুক নিমু না। এই কথা বইলা ট্যাকা ফেরত চাইছি। হেরা দিবো না! কয়, পুলিশ ঝামেলা করতাছে, তাই এহন দাম একটু বেশিই হইবো। নিলে নে, না নিলে চইলা যা!’
মাদক বিক্রির একই রকম চিত্র দেখা গেছে বাবর রোডের মসজিদ গলির মুখে এবং গলি ধরে ভেতরের দিকে বোবার বিরিয়ানির দোকান সংলগ্ন জায়গায়। এ ছাড়া ভেতরের আরও দুটি জায়গা এবং হুমায়ুন রোডের গলিতেও হাঁকডাক দিয়ে বিক্রি করতে দেখা যায় নানান মাদকদ্রব্য।
ক্যাম্প ঘুরে ফের হুমায়ুন রোডের মুখে এসে দেখা যায়, ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী এক ছেলে একটি মাঝারি আকারের পলিথিনভর্তি গাঁজার পুঁটলি নিয়ে পথচারীদের ডেকে ডেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তার কাছে গাঁজা কিনতে চাইলে বলে, ‘কী পরিমাণ দেব?’ দাম কত—এমন প্রশ্নের জবাবে বলে, ‘পঁচিশ (২৫ গ্রাম) নিলে ৯০০ টাকা। সাড়ে ১২ (১২.৫ গ্রাম) নিলে সাড়ে চারশ টাকা। এর কমে বেচি না।’ আরও কিছু প্রশ্ন করলে বলে ওঠে, ‘লইলে লন, না হইলে সময় নষ্ট কইরেন না। যে কোনো সময় পুলিশ আইসা পড়বে।’
জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান এবং অভিযান শেষ হওয়া মাত্র মাদক বিকিকিনির বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান গতকাল সন্ধ্যায় কালবেলাকে বলেন, ‘সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমরা অভিযান চালিয়েছি। জেনেভা ক্যাম্প থেকে বেশ কয়েকজনকে আটক করেছি। প্রাথমিকভাবে সব কিছু যাচাই-বাছাই চলছে। মামলা হলে আমরা আরও বিস্তারিত জানাব।’
এদিকে সংঘর্ষে শাহ আলম নামে যে যুবককে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে, সে ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান বলেন, ‘শাহ আলমের পরিবার থানায় এসেছে। মামলার এজাহার লেখা হচ্ছে। এসব ঘটনায় ক্যাম্পের বাজারের ভুক্তভোগীরা মূলত মামলা করতে চায় না। তাদের হিসাব আছে, সেসব চিন্তাভাবনার পর মামলা করে।’
যদিও এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে ক্যাম্পের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ফয়সাল (২৫) ও সেলিমকে (২৪) গত সোমবার গ্রেপ্তার করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। সে সময় তাদের কাছ থেকে দুটি ধারালো চাপাতি জব্দ করা হয়। এ ছাড়া সেদিন রাতেই র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথ অভিযান পরিচালনা করে জেনেভা ক্যাম্পে। অভিযানের সময় বিপুল মাদক, অস্ত্রসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। শাহ আলম হত্যা ও অন্যান্য অভিযোগে মোট গ্রেপ্তার হয়েছে ১৬ জন।
প্রায় সপ্তাহ ধরে চলা সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, পিচ্চি রাজাসহ জেনেভা ক্যাম্পে সক্রিয় ২৪ জন মাদক কারবারিকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিস্ফোরক আইনে করা এ মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান।