নিজস্ব প্রতিবেদক :: চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, লুণ্ঠন এবং দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ বানিয়েছেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। মজার ব্যাপার হলো, নানক তাঁর অবৈধ সম্পদ দিয়ে কোনো দৃশ্যমান বিশাল স্থাবর সম্পত্তি কেনেননি, বরং ছোট ছোট বিনিয়োগ করেছেন। এসব বিনিয়োগ এখনো অপ্রকাশিত। নানকের অবৈধ অর্থের একটি বড় অংশ ভারতে পাচার করা হয়েছিল।
সেখানে তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে বিনিয়োগ করেছেন; যে বিনিয়োগে টাকা দিয়ে তিনি এখন কলকাতায় বিলাসী জীবন যাপন করছেন। আর একটি অংশের টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন, জমি কিনেছেন। তবে নানকের ঘনিষ্ঠ অনেকে মনে করেন এসব ফ্ল্যাট বা জমি নানক যতটা না কিনেছেন, তার চেয়ে বেশি দখল করেছেন। যেখানে বড় ধরনের কোনো নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে, সেখানে গিয়ে তার হিস্সা নেওয়াটা ছিল নানকের জন্য একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
ব্যবসায়ীরাও নানককে ভয় পেতেন। তাঁরা মনে করতেন শেষ পর্যন্ত নানককে যদি তাঁর চাহিদামতো ফ্ল্যাট, জমি না দেওয়া হয়, তাহলে তাঁদের ব্যবসা করা সম্ভব হবে না। এভাবেই নানক দুর্নীতির সাম্রাজ্য বৃহৎ বিস্তার করেছিলেন।
উত্তরা থেকে শুরু করে পুরান ঢাকা পর্যন্ত নানকের সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
যদিও দুর্নীতি দমন কমিশন কাগজে কলমে এসব সম্পদের কোনো কূলকিনারা এখন পর্যন্ত করতে পারেনি। কারণ এ ধরনের সম্পদের অধিকাংশই বেনামি। ছদ্ম মালিকের মাধ্যমে নানক এ সম্পদগুলো উপভোগ করছেন। উত্তরায় নানকের অন্তত ১০টি ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছেন। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর, ১৩ নম্বর সেক্টর এবং জসীমউদ্দীন সড়কে নানকের দোকান এবং ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে অন্তত একজন বিল্ডার্স গণমাধ্যমকে নিশ্চিত জানিয়েছেন যে নানকের লোকজন এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার সময় হুমকি দেন। এরপর তিনটি দোকান নানকের নামে বরাদ্দ দিতে হয়। নানক এ দোকানগুলো প্রথমে তাঁর মেয়ের নামে নেন। পরে তাঁর বিশেষ সহকারী বিপ্লবের নামে এসব রেজিস্ট্রি করেন। ৫ আগস্টের পর বিপ্লবের নামে থাকা এ দোকানগুলো জনৈক তালেবুর রহমানের নামে হস্তান্তর হয়েছে বলে দেখা যায়। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরে জাহাঙ্গীর কবির নানকের নামে চারটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। একটি নামী বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠান নানককে এসব ফ্ল্যাট উপহার হিসেবে দিয়েছে বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। এ ফ্ল্যাটগুলো নানক ২০২৩ সালে বেনামী হস্তান্তর করেছেন। উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে নানকের ছয়টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলোর নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জমির মালিক নানককে এ ফ্ল্যাটগুলো হিবা দলিলের মাধ্যমে হস্তান্তর করেন। পরে নানক জনৈক আলিমুদ্দিনের কাছে এ ফ্ল্যাটগুলো দানপত্রের মাধ্যমে হস্তান্তর করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ ফ্ল্যাটগুলোর প্রকৃত মালিক নানকই। এগুলো বর্তমানে ভাড়া দেওয়া আছে। সরেজমিন দেখা যায়, এ ভাড়ার টাকা নানকের মেয়ের বর্তমান স্বামীর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া গুলশানে নানকের চারটি ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে। গুলশানের ২১, ২৩ এবং ১০২ নম্বর সড়কে নানকের ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে; যেগুলো প্রথমে নানকের স্ত্রী নার্গিসের নামে ছিল।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, যাঁরা এ ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণ করেছেন, তাঁরা হিবা দলিলের মাধ্যমে নানকের স্ত্রীকে এগুলো হস্তান্তর করেন। পরে নানকের স্ত্রী রাবেয়া আক্তার নামে একজন অজ্ঞাতপরিচয় নারীর কাছে ফ্ল্যাট দানপত্রের মাধ্যমে হস্তান্তর করেন। কিন্তু এখন তদন্তে পাওয়া যাচ্ছে যে এ ফ্ল্যাটগুলোর মালিকানা এখনো নানকের। কাগজপত্রে এসব ফ্ল্যাট নানকের তা প্রমাণ করা অসম্ভব ব্যাপার। বনানীতে নানকের অন্তত ছয়টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এখানে দেখা যায় নানকের গাড়িচালক সেকান্দার এবং দেহরক্ষী ও ব্যক্তিগত কর্মচারী বিপ্লবের নামে এ ফ্ল্যাটগুলো কেনা হয়েছিল। পরে বিপ্লবের কাছ থেকে জনৈক গিয়াসউল আলমকে এ ফ্ল্যাটগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। একই কায়দায় ধানমন্ডিতে নানকের ৩১টি ফ্ল্যাট রয়েছে। যেগুলো থেকে এখনো নিয়মিত ভাড়া আদায় হচ্ছে। নানকের লোকজন এ ভাড়ার টাকা তুলছেন। ৫ আগস্টের পর নানক বিদেশে চলে গেলেও ঢাকা শহরে যে তাঁর ১৬০টির মতো ফ্ল্যাট আছে, এর অধিকাংশই ভাড়া দেওয়া আছে এবং ভাড়ার টাকা নিয়মিত ওঠাচ্ছেন তাঁর লোকজন। সে টাকা নানকের কাছে চলে যাচ্ছে। একাধিক সূত্র বলছেন, মোহাম্মদপুর এবং ধানমন্ডিতে নানকের ফ্ল্যাটগুলোয় যাঁরা থাকেন, তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছে এখন কোনো চেকের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হবে না, দিতে হবে সব নগদ অর্থে। এ ছাড়া ধানমন্ডির চারটি মার্কেটে নানকের অন্তত ১২টি দোকানের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এভাবে ফ্ল্যাট এবং দোকান কিনেই নানক ক্ষান্ত হননি। পুরো মোহাম্মদপুর, পিসি কালচার, বছিলা এবং কেরানীগঞ্জ জুড়ে নানকের জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। নানকের জমির পরিমাণ ১০০ বিঘার বেশি। অধিকাংশই দখলকৃত বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছেন। মোহাম্মদপুরে নানকের অন্তত ২০ বিঘা জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর এক জায়গায় গরুর খামার তৈরি করা হয়েছে। যেটি একটি প্রতিষ্ঠানকে নানকের পক্ষ থেকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাকি জমিগুলোর মধ্যে কিছু এখনো দেয়ালঘেরা অবস্থায় পড়ে আছে। পিসি কালচারের বিভিন্ন এলাকায় সাইনবোর্ড দেখা যায়-‘এ জমির মালিক অমুক’। এসব সাইনবোর্ডের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাহাঙ্গীর কবির নানকের লোকজনই এ জমিগুলোর মালিক। যেহেতু কাগজপত্রে কোথাও নানকের নাম নেই, সেজন্য নানককে এসব জমির জন্য আইনগতভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু এলাকাবাসীর সবাই জানেন এসব জমির মালিক নানক। এখন পর্যন্ত অবৈধ পন্থায় অর্জিত এসব জমি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসার পর জাহাঙ্গীর কবির নানককে একটি পাওয়ার প্ল্যান্টের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছিল। এ লাইসেন্সটি নানক তিন দফা বিক্রি করেন বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রথমে তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী এবং অন্যতম ক্যাডার প্রয়াত আসলামুল হকের কাছে বিক্রি করেছিলেন। আসলামুল হকের কাছ থেকে তিনি এ বাবদ ২০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন বলে দুজনের মধ্যে সমঝোতা চুক্তিতে দেখা যায়। এরপর নানক একই পাওয়ার প্ল্যান্ট একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেন। সেখান থেকেও তিনি টাকা নেন। পরে ওই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তুলে তিনি আরেকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে এটি বিক্রি করেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এ পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য আসলামুল হককে তিনি একটি জমি দেন। তদন্তে দেখা যাচ্ছে এটি নদী ভরাটের জমি এবং সরকারি খাসজমি। সরকারি প্রায় ১০ বিঘা খাসজমি দখল করে আসলামুল হকের কাছে বিক্রি করেছিলেন নানক। বিভিন্ন সূত্র বলছেন, এভাবে সরকারি খাসজমি দখল করে ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক কর্মীর কাছে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে বিক্রি করা ছিল নানকের অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস। ফলে তাঁর এসব সম্পদ যারা কিনেছেন, তারা এখন বড় ধরনের বিপদে পড়েছেন। এভাবে সন্ত্রাস এবং ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অবৈধ পন্থায় ভূমি-ফ্ল্যাট দখল করে নানক হয়েছেন হাজার কোটি টাকার মালিক।