
নিজস্ব প্রতিবেদক :: মুজিব চেতনা নিয়ে সেই নুরুল ইসলাম ফের জিলা স্কুলে।
মুজিব আমার চেতনা, মুজিব আমার বিশ্বাস। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এমন একাধিক বই লেখা বিতর্কিত শিক্ষক নুরুল ইসলাম ফের বরিশাল জিলা স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। শুধু তাই নয়, ২০২৩ সালে ‘চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ অন্তরে বঙ্গবন্ধু’ ও ‘মার্চের চেতনা জন্ম-ভাসন স্বধীনতা’ নামে দুটি বই লিখে বরিশাল জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। মাদারীপুর ইউনাইটেড সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে নিজ খরচায় শেখ মুজিবের মুরাল নির্মান করেছিলেন মুজিবপ্রেমী এই শিক্ষক। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় ৭ মার্চের ভাষন, ১৫ আগষ্ট, শেখ মুজিবের জন্মদিনে নিয়মীত কলামও লিখতেন এই শিক্ষক। গত মঙ্গলবার ৯ সেপ্টেম্বর সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অনিতা রানী হালদারকে সরিয়ে নতুন প্রধান শিক্ষক হয়েছেন তিনি। এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতি মধ্য দিয়েই বরিশাল জিলা স্কুলে যোগদান করেছেন তিনি। সরকারি নিয়মানুযায়ী কেউ বদলি হলে আগে তাকে কর্মস্থল থেকে রিলিজ নিয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করার কথা বলা হলেও বর্তমান জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আগে যোগদান করেছেন এবং পরে রিলিজ নিয়েছেন। তার নতুন কর্মস্থলে যোগদানের অর্ডার প্রকাশিত হয়েছে গত মঙ্গলবার ৯ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা ৩৯ মিনিটে। তিনি তার পরের দিন বুধবার ১০ সেপ্টেম্বর সকাল ৮ টায় জিলা স্কুলে যোগদান করেন। যোগদান করার পর তার পূর্ববর্তী কর্মস্থল ঝালকাঠি সরকারি বালিকা বিদ্যালয় গিয়ে রিলিজ নেন। সেখানে তিনি ব্যাকডেটে সই করেছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ঝালকাঠির সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সদ্য প্রধান শিক্ষক মোঃ আবু সাঈদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বুধবার ১০ সেপ্টেম্বর সকাল ৭ টায় আমি তার বাসাই গিয়ে দেখা করি। আমাদের দুজনের বাসা বরিশাল শহরে। তার বাসায় বসেই শিক্ষক নুরুল ইসলাম আমার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। শুধু তাই নয়, সদ্য যোগদানকৃত প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলাম স্কুলের শতাধিক কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ক্লাস বন্ধ রেখে কঠোর রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা নিয়েছেন। এ ঘটনায় স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এতে প্রথম ক্লাসের পর পরবর্তী তিনটি ক্লাস হয়নি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিষয়টি আমার ভালো জানা নেই। এর আগেও অনেকেই আমার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছে। তাই বিষয়টি ভালোভাবে জেনে আপনাদের সাথে সরাসরি কথা বলবো। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, বিগত আওয়ামী সরকারের দালাল খ্যাত নুরুল ইসলাম দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তৎকালীন স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন একের পর এক দূর্নীতি-অপকর্ম চালিয়েছেন। নিজের ফেসবুক আইডিতে হরহামেসাই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের গুনকীর্তন চালিয়ে যেতেন এই শিক্ষক। তবে এখন ক্ষমতার পালা বদলে নিজ স্বার্থ হাসিলে নুরুল ইসলাম নতুনভাবে জামায়াত-বিএনপির সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। এমন একজন শিক্ষক কিভাবে পুনরায় জিলা স্কুলে যোগদান করেছেন বিষয়টি নিয়ে মাউশির সহকারী পরিচালক জিয়াউল হায়দার হেনরী কাছে জানতে চাইলে তিনি ডাক্তারের চেম্বারে আছেন বলে লাইন কেটে দেন। পরবর্তীতে কথা বলার জন্য তাকে মোবাইলে ম্যাসেজ দিলেও সাড়া দেননি। তবে বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. রায়হান কাওছার বিষয়টি নিয়ে মাউশিতে কথা বলার নির্দেশ দেন। মাউশি’র পরিচালকের সাথে কথা হয়েছে তবে এ বিষয়ে কিছু বলেননি এমনটি জানালে তিনি পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দেন। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে বরিশাল জিলা স্কুলের ফান্ড থেকে লাখ টাকা মূল্যের স্যামসাং ব্রান্ডের একটি টেলিভিশন ক্রয় করার কিছুদিন পর মেরামতের কথা বলে টিভিটি বাসায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্কুল থেকে বদলি হয়ে গেলেও টিভি আর ফেরত দেয়নি তিনি। এছাড়াও স্কুলের ফান্ড থেকে ১টি ল্যাপটপ কম্পিউটার, ১টি ডেক্সটপ কম্পিউটার ও একটি প্রিন্টার মোট একলাখ বায়ান্ন হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করে ল্যাপটপ ও ডেক্সটপ কম্পিউটার দুইটি স্কুলে জমা দেয়নি নুরুল ইসলাম। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ঝালকাঠি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছিল তাকে। এর আগে ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। সেখানেও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির পাশাপাশি নারী কেলেঙ্কারির মতো জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
ঝালকাঠীর এক অভিজাত হোটেলে নারীসহ ধরা পড়লে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পালিয়ে এসে বরিশাল জেলা শিক্ষা অফিসে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলেন। পরে তাকে বরগুনা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু বরগুনাতেও তিনি একই ধরনের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন এবং স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের মুখে তাকে দুই দিন অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে হয়েছিল। বরগুনাতে নানা অঘটনের জন্ম দিয়ে কয়েক মাস পরই বদলি হন মাদারীপুর ইউনাইটেড সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। মাদারীপুরে অবস্থানকালে নুরুল ইসলামের দুর্নীতি আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। তৎতালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা শাজাহান খানের সাথে পারিবারিক সখ্যতা গড়ে তুলে নাম ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নিয়ম-নীতির কোনরুপ তোয়াক্কা না করে সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান এর সাথে গোপনে স্ব-পরিবারে হজ পালন করেন। এমনকি দেশের বাইরে অবস্থানকালীন সময়ে অর্ধ বেতন এর নিয়ম-নীতিকে লঙ্ঘন করে তুলেছেন পুরো মাসের বেতন। তবে তার এই অনিয়ম ও দুর্নীতি স্থানীয় জনগণের চোখ এড়াতে পারেনি। তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে তাকে বরিশালে বদলি করা হয়। এরপর ২০২১ সালে বরিশাল জিলা স্কুলে যোগদান করেন। বরিশাল জিলা স্কুলে যোগদানের পর সুচতুর নুরুল ইসলাম সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ ও সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর জাহিদ ফারুকের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। এরপরই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নানা অনিয়য়ে জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকসহ সিন্ডিকেট করে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন। স্কুলের ছাত্রদের কাছ থেকে প্রতি মাসে আইসিটি বাবদ ২০ টাকা করে আদায় করার পরেও এককালীন ছাত্র প্রতি ২৪০ টাকা আদায় করতেন যা সম্পূর্ণরূপে আইন পরিপন্থী এবং এই টাকার হিসাব কোন শিক্ষকই তখন জানতেন না। এছাড়াও ভুয়া বিল করে স্কুলের উন্নয়নের নামে বিভিন্ন ফান্ডের লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন তিনি। সরকারি বিধি অনুযায়ী খরচ করার বিধান থাকলেও তিনি ওই বিধানের তোয়াক্কা না করে লোক দেখানো কিছু কাজ করে বেশিরভাগ টাকা পকেটস্থ করেছিলেন এবং শিক্ষকদের জোরপূর্বক ভাউচারে স্বাক্ষর নিয়েছিলেন। স্কুলের ক্রীড়া ফান্ড থেকে নিজ ও পরিবারের জন্য মোটা অংকের টাকাও হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এমনকি বেসরকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের কারনে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল তাকে। ২০২৩ সালের মাসে বরিশাল-২ আসনের (উজিরপুর-বানারীপাড়া) সাবেক সংসদ সদস্য মো. শাহে আলম তালুকদারের নির্দেশে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত রাখায় দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন তিনি। যা বিভিন্ন পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হয়েছিল। এছাড়াও বেসরকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র সরবরাহের অসংখ্য অভিযোগও রয়েছে নুরুল ইসলমের বিরদ্ধে। এছাড়াও স্কুলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বেসরকারী স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী না রেখে তাদের সম্মানী নিজেই আত্মসাত করতেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলামের স্কুলে যোগদানের পূর্বে তদন্ত আরও স্বচ্ছভাবে হওয়া উচিত ছিল।


