নিজস্ব প্রতিবেদক :: বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বরিশাল-৫ (সদর) আসনের সমীকরন ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। বিশেষ করে মহানগর বিএনপির মধ্যে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে আগেভাগে জামায়াত ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী ঘোষনা করায় তারা নির্বাচনী মাঠে থাকলেও বিএনপির প্রার্থী ঘোষনা না হওয়ায় একাধিক প্রার্থী বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে তাদের প্রার্থীতা জানান দিচ্ছেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী এবারের নির্বাচনে বড় একটি দল না থাকায় ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে মরিয়া জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তার মধ্যে বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতিবাচক কর্মকান্ড সাধারন ভোটার আড় চোখে দেখায় যাকেই বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেয়া হউক না কেন তাকে বিজয়ী তোড়ন উড়ানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
বরিশাল মহানগর বিএনপি কয়েকভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে মহানগর বিএনপির বাইরে যারা রয়েছেন তারাও এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক, সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার জিয়া, ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খান নাসরিন, সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদসহ একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ায় এর প্রভাব ফেলবে সংসদ নির্বাচনে।
এর মধ্যে সদর আসন থেকে প্রার্থী হতে মরিয়া বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার, উপদেষ্টা এ্যাড. মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ, সাবেক বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাড. বিলকিস জাহান শিরীন, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক ও ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন।
এদিকে জামায়াত ইসলামী থেকে একক প্রার্থী ঘোষনা করা হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারি সেক্রেটারী জেনারেল এ্যাড. মুয়াযযম হোসাইন হেলালকে। একইভাবে ইসলামী আন্দোলন থেকে হাতপাখা নিয়ে প্রার্থী হবেন চরমোনাই পীরের ভাই মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম।
পরিসংখ্যান বলছে ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ আসনে দুটি উপ নির্বাচনসহ ১০টির মধ্যে ৮টিতে জয় পেয়েছিল বিএনপি। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ এবং ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি একবার করে বিজয়ী হয়। এ আসনে চারবারের এমপি ছিলেন মজিবর রহমান সরোয়ার। এছাড়া প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাস এবং তার ছেলে ডা. এহতাশেমুল হক নাসিম বিশ্বাস উপ-নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বারবার বিএনপি এ আসনে নির্বাচিত হওয়ায় এটিকে বিএনপির ঘাটি বলা হয়।
তবে এবারের নির্বাচন সকল পরিসংখ্যান পাল্টে দেয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারন আওয়ামীলীগের নীরব ভোট এ পরিসংখ্যান পাল্টে দিতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। তার মধ্যে বিএনপির একাধিক ভাগে বিভক্তও ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে। প্রভাব পড়বে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনৈতিক কর্মকান্ড। আর বিএনপির এসব দুর্বল জায়গায় আঘাত হেনে ভোটের মাঠে রাজত্ব করতে মরিয়া জামায়াত ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা। যেখানে ৫ আগস্ট পরবর্তী দুটি দলের প্রার্থীরা ভোটারের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন সেখানে বিএনপি প্রার্থীরা তাদের নিজস্ব বলয় তৈরীতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। তারা এখন পর্যন্ত ভোটারের কাছেই যেতে পারেননি। তাদের ধারনা ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বরিশাল সদর আসন থেকে যাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে তিনিও বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ের মালা পরিধান করবেন। কিন্তু সেই ঘাঁটিতে নিরব ভোট বিপ্লবের অপেক্ষায় রয়েছেন অন্য প্রার্থীরা।
২০০৮ সালে নির্বাচনে ৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপি প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল অব. জাহিদ ফারুক শামীম। সর্বশেষ সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন ৩৪ হাজার। এ কারনে তাদের নির্বাচনী মাঠ হাতের নাগালে।
৫ আগস্ট পরবর্তী জামায়াত ইসলামী বরিশাল সদর আসনের প্রার্থী ঘোষনা করেন। ঘোষনার পর থেকে একটি মুহূর্ত বসে থাকেননি এ্যাড. মুয়াযযম হোসাইন হেলাল। তিনি সদর আসন চষে বেড়াচ্ছেন। এমনকি বিভিন্ন জায়গায় তার বড় বড় ব্যানারও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেখানে বিএনপির প্রার্থীই ঠিক হয়নি সেখানে জামায়াত ইতিমধ্যেই তাদের ভোট কেন্দ্রের কর্তব্যরতদের কয়েকদফা সচেতনতা সভা করে ফেলেছেন। কিন্তু সে ধরনের কোন প্রচার প্রচারনায় নেই বিএনপির প্রার্থীরা। তারা তাদের কর্মসূচীতে শো-ডাউন করে তাদের প্রার্থীতা জানান দিচ্ছে। যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চান তারা গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এমনকি মহানগর থেকে যারা ছিটকে পড়েছেন তারাও পৃথকভাবে তাদের কর্মসূচী পালন করছেন। অপরদিকে চরমোনাই অনুসারী ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী তাদের প্রতিটি কর্মসূচীতে হাতপাখা প্রতীকের পাশাপাশি প্রার্থী ফয়জুল করিম ভোট চাচ্ছেন। তারা পিআর পদ্ধতিতে ভোটে যেতে চাইলেও নির্বাচনে অংশগ্রহনের প্রস্তুতি চলছে।
এ ব্যাপারে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, বড় দলে বিভক্তি থাকতে পারে। তবে দল মনোনয়ন নিশ্চিত করার পর সেই বিভক্তি আর থাকে না। ওই সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচনী মাঠে থাকবে সকল নেতাকর্মী। আমি চারবারের এমপি এবং প্রথম সিটি মেয়র। সেই স্থান থেকে আমি মনোনয়ন চাইবো এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া দলের ক্লান্তিলগ্নে সরোয়ারকে পাওয়া যায়নি এমন কথা কেউ বলতে পারবে না।
বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আগামী নির্বাচনে বরিশাল-৫ আসনে তিনি দলের মনোনয়ন চাইবেন। নিজের পরিকল্পনামতো এগোচ্ছেন। তিনিও দাবি করেন মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর গ্রুপ আর থাকবে না। ওই সময় নেতাকর্মী বিএনপির প্রার্থীকে বিজয়ী করতে মরিয়া হয়ে সাধারন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাবেন।
এ ব্যাপারে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার বলেন, বিভাগীয় শহর হওয়ায় বরিশাল সদর আসনের গুরুত্ব রয়েছে। এ কারনে জিয়া পরিবার থেকে একজন মনোনয়ন দেয়ার জন্য তিনি প্রস্তাব করেছেন। তারপরও কেন্দ্র থেকে যাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে তার পক্ষে মহানগর বিএনপি কাজ করবে। তরুনদের ভোটের বিষয়ে বলেন, বিএনপির সদস্য সংগ্রহকালে তরুন ভোটারদের আগ্রহ দেখা গেছে দলের প্রতি। সদস্য সংগ্রহকালে তাদের অনুভুতি বোঝার চেষ্টা করেছি। তাতে করে বিএনপির প্রার্থীকেই তারা নির্বাচিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কিছু নেতাদের অনৈতিক কর্মকান্ড কোন প্রভাব ফেলবে কিনা। এর উত্তরে জিয়া বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছোট অপরাধকারীকেও মাফ করেননি। তাদের বিরুদ্ধেও দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে। সেখানে তাদের কর্মকান্ড কোনভাবেই প্রভাবিত করবে না বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে সভা সমাবেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও বরিশাল ৫(সদর) আসনের জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী অ্যাডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলাল বলেন, সারাদেশের মতো বরিশাল নগরীতেও দাঁড়িপাল্লার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ এবার প্রকৃত পরিবর্তন চাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনের সময় আমাদের নেতৃবৃন্দকে জুলুমের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে, তাদের শুধু একটাই দোষ তারা দেশকে ভালোবাসতো। স্বাধীনতার পরে এদেশে অনেক শাসন হয়েছে, শাসনের নামে শোষণ হয়েছে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য দরকার রাসুলুল্লাহ সাঃ এর নির্ধারিত পদ্ধতিতে সমাজ পরিচালনা করা, তাহলে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। চার খালিফার আদলে নেয়া ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। মানুষ দীর্ঘদিন পরে তাদের মূল্যবান ভোটাধিকারের মাধ্যমে এই স্বপ্ন পূরণ করবেন।
১৯৭৩ সালে আওয়ামীলীগ থেকে আবদুল মান্নান হাওলাদার, ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে সুনীল কুমার গুপ্ত, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এম. মতিউর রহমান, ১৯৯১ সালে বিএনপি থেকে আব্দুর রহমান বিশ্বাস, ১৯৯১ সালের উপ-নির্বাচনে বিএনপি থেকে মজিবর রহমান সরোয়ার, ১৯৯৬ সালের উপ-নির্বাচনে বিএনপি থেকে নাসিম বিশ্বাস। নাসিম বিশ্বাসের মৃত্যুর পর ১৯৯৮ সালের উপ-নির্বাচন থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত টানা তিনবার মজিবর রহমান সরোয়ার নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে শওকত হোসেন হিরন, হিরনের মৃত্যুর পর ২০১৪ এর উপ-নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে জেবুন্নেছা আফরোজ, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা দুইবার আওয়ামীলীগ থেকে জাহিদ ফারুক শামীম এমপি নির্বাচিত হন। বিগত নির্বাচনী ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় যে বরিশাল সদর আসনে বিএনপির রিজার্ভ ভোট আছে ৬০ হাজার, আওয়ামী লীগের আছে ৩৫ হাজার, এবং ইসলামী দলগুলোর জামায়াত এবং চরমোনাইর মিলে এই সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। সে ক্ষেত্রে ভয়াবহ অবস্থায় আছে নতুন ভোটারের সংখ্যা। এই নতুন ভোটাররাই যেই দিকে ঝুকবে তাদের পাল্লাই ভারি হবে। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের পর গোটা নির্বাচনী ফলাফল তারুন্য নির্ভর হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি’র যা রিজার্ভ ভোট আর দলীয় যা কোন্দল এবং মাঠ পর্যায়ে কিছু নেতাকর্মীদের অন্যায়-অত্যাচারের কারণে প্রার্থী এলোমেলো হলে ফলাফলে কি হবে সেটা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।