সালেহ টিটু :: বরিশাল নগরীর সীমান্তবর্তী ঝালকাঠির দপদপিয়া এলাকায় অপসোনিন গ্রুপ ১০ একরের অধিক জমি দখল করে কীর্তনখোলা নদী ভরাট করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই জমি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার তিমিরকাঠী ইউনিয়নের শতাধিক বাসিন্দাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। গেল ২৫ থেকে ৩০ বছরের ব্যবধানে কীর্তনখোলা নদীর ভাঙ্গনে তিমিরকাঠী এলাকা থেকে ওপাড়ে সিকিস্তি হিসেবে জমি জেগে ওঠলে তা দখলে নেয় অপসোনিন।
দখলে নিয়ে খ্যান্ত হয়নি, ব্লক ফেলে জমির সাথে সাথে দখল করে নিয়েছে নদীও। এ নিয়ে আন্দোলন হলেও তৎকালীন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ এর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর ছত্রছায়ায় থাকায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি জমি ও নদী। এমনকি আন্দোলনের কারনে উল্টো হামলার শিকার হতে হয়েছে ভূমি হারানো ব্যক্তিদের। তবে গেল বছর ৫ আগস্টের পর জমি উদ্ধারে আন্দোলনে নেমেছে ভূমি হারানো ব্যক্তিরা।
ভূমিহারা রমজান আকন ও মো. হাসানসহ তিমিরকাঠী এলাকার একাধিক ব্যক্তি বলেন, কীর্তনখোলা নদী সংলগ্ন তিমিরকাঠী ইউনিয়ন। সেখানে ইউনিয়নের শতাধিক ব্যক্তির ১০ থেকে ১২ একর জমি গেল ৩০ বছরের ব্যবধানে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। পরবর্তীতে ওই জমি ভাঙ্গনকবলিত এলাকার ওপারে দপদপিয়া ইউনিয়নে স্থাপিত ভূমিখেকো অপসোনিন কোম্পানীর জমির সাথে জেগে ওঠে। জমি জেগে ওঠার সাথে সাথে অপসোনিনের লোকজন তা দখল করা শুরু করে। জমি জেগে উঠলে তারা সাথে সাথে সেখানে ব্লক ফেলে তাদের জমির সাথে এক করে ফেলেন। এভাবে গেল ২০ বছরের ব্যবধানে তাদের ভাঙ্গনকবলিত জমির ১০ থেকে ১২ একর অপসোনিন দখল করে নিয়েছে। এর সাথে সাথে দখল করেছে কীর্তনখোলা নদীর জমিও। রাত-দিন ব্লক তৈরী করে তা নদীতে ফেলে ওই জমি দখলে নেয়।
ওই সময় বাধা দেয়া হলে আমুর লালিত গুন্ডা বাহিনী তাদের উপর হামলা চালায়। এমনকি তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হুমকি-ধামকি দেয়। এ কারনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন কোন ধরনের টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারেননি তারা। অথচ ভাঙ্গনে তাদের একের পর এক জমি বিলীন হয়ে তা আবার জেগে উঠলেও তা ভূমিখেকোর পেটে থাকায় তাদের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। কারন পূর্বে ওই জমি চাষাবাদ এমনকি বর্গা দিয়ে তাদের বছরে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালাতেন। ভাঙ্গনকবলিত হওয়ার পর তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে ওই জমি জেগে উঠলে তাদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চার হয়। কিন্তু ভূমিখেকোর কারনে ওই জমি উদ্ধার করা সম্ভব না হওয়ায় তাদের কষ্টে কাটছে দিনগুলো।
রমজান আকন আরো বলেন, গেল বছর ৫ আগস্টের পর তিনদফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে সিকিস্তি জমির শতাধিক মালিক। তারা তিমিরকাঠী এলাকায় মানববন্ধন থেকে শুরু করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাদের প্রথম দাবি ছিল প্রকৃত জামির মালিকদের নিকট জমি ফিরিয়ে দেয়া। জমির খাজনা দেয়ার ব্যবস্থা করা এবং বিগত আমলে তাদের উপর যারা হামলা চালিয়েছে তাদের বিচার। এরপর ঝালকাঠী জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে তাদের ডেকে নেয়া হয়। সেখানে অপসোনিন মালিক পক্ষের সাথে তাদের বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তারা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও মালিক পক্ষ আর সেখানে আসেনি। এ কারনে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষনা দিয়েছেন। যে কোন মূল্যে তারা তাদের জমি ফেরত চান।
দপদপিয়া ফেরীঘাট এলাকার নৌযান চালক নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, তার কাছ থেকে মাসব্যাপী ইঞ্জিনচালিত নৌযান ভাড়া নেয় অপসোনিন। এরপর অপসোনিনের ভিতর তৈরী করা সিমেন্টের ব্লক নৌযানে করে নদীর ভিতরে নিয়ে আসতো। সেখান থেকে শ্রমিকরা নদীতে ফেলতো। এভাবে কিছুদিন ফেলার পর বিশাল এলাকা নিয়ে চর জেগে ওঠে। পূর্বে যে চর পানির নীচে ছিল সেখান থেকে পানি সরে গিয়ে একের পর এক জমি জেগে ওঠে। তিনি শুনেছেন ওই জমি হচ্ছে ওপারের তিমিরকাঠী এলাকাবাসীর ভাঙ্গনকবলিত জমি। এরপর ওই জমি যাতে কোনভাবেই নদীগর্ভে বিলীন না হয় সে জন্য আবারো ব্লক ফেলা হয়। এ জমি দখল করায় এখন বড় বড় জাহাজ চলাচলেও সমস্যা পড়তে হয় বলে জানান তিনি। অপসোনিন প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ কোন টা-টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারে না। এখন দিন পাল্টেছে যাদের জমি তারা ওই জমি উদ্ধার করতে পারেন। এ সময় তাদের নৌযান নিয়ে অপসোনিনের দখলস্থলে যেতে চাইলে কোন নৌযান তাতে রাজী হয়নি।
ওই নৌযান চালক আরো বলেন, আপনি চরকাউয়া খেয়াঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ে আসবেন। এরপর অপসোনিন এলাকায় গেলে দেখতে পাবেন সেখানকার নদী এক প্রকার খালে রূপ নিয়েছে। যেখানে পূর্বে বড় বড় জাহাজ ঘুরতে সমস্যা হতো না। এখন অপসোনিনের দখলের কারনে সেখান বড় বড় নৌযান চালাচলে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। নদী তো সরকারের তারা তো ইচ্ছে করলে নদীর জমি দখলমুক্ত করতে পারে। কিন্তু তারাও ছিল অপসোনিনের কাছে জিম্মি।
এ ব্যাপারে নদী গবেষক রফিকুল আলম বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে কীর্তনখোলা দখলদারদের চিহ্নিত এবং কি পরিমান জমি দখল হয়েছে সে বিষয়ে সরেজমিনে কাজ করেছেন। এ নদী দখলে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ৪ হাজার ১৯২ দখলদার। কীর্তনখোলা নদী দখলে এগিয়ে রয়েছে অপসোনিন গ্রুপ, খানসন্স, প্রান গ্রুপ এবং কোস্টগার্ড।
তিনি আরো বলেন, তিমিরকাঠী এলাকার বড় একটি অংশ কীর্তনখোলা নদীতে বিলীন হয়েছে। ওই জমি জেগে উঠেছে অপসোনিন কোম্পানীর জমির সাথে। এরপর একটি চক্র সিকিস্তি ওই জমি অপসোনিন কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে বলে তিনি শুনেছেন। এরপর অপসোনিন গ্রুপ সিকিস্তি জমির সাথে নদীর জমিও দখল করে ব্লক ফেলে তা কোম্পানীর মধ্যে নিয়ে নেয়। অতি শীঘ্রই মৌজাম্যাপ অনুযায়ী অপসোনিন কোম্পানীর জায়গায় পিলার বসানো হবে। তারা নদী এবং সিকিস্তি জমি দখল করেছে। এ ব্যাপারে সরকার কে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে অপসোনিন কোম্পানীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে আজকের পরিবর্তনকে বলেন, তারা নদী কিংবা কোন ব্যক্তির জমি দখল করেননি। তিমিরকাঠী এলাকা ভেঙ্গে যে জমি এপারে উঠেছে তা ওই ভাঙ্গনকবলিত ব্যক্তিদের কাছ থেকেই ক্রয় করা হয়েছে। এরপর নদী সংলগ্ন দলিলকৃত জমি তাদের নিয়ন্ত্রনে নেয়া হয়। আর তাদের জমি যাতে নদীগর্ভে বিলীন না হয় সে জন্য ব্লক ফেলা হয়। এখানে কারো জমি দখল করা হয়নি দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।