নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশাল সহ সারা দেশের সাথে মেঘনা পাড়ের মুলাদী ও হিজলা উপজেলার সরাসরি এবং মেহেন্দিগঞ্জের পরোক্ষ সড়ক যোগাযোগ নিরবিঘ্ন করতে সম্পূর্ণ দেশীয় তহবিলে মীরগঞ্জে আঁড়িয়াল খাঁ নদের ওপর সেতু নির্মান কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হচ্ছে রোববার। এ উপলক্ষে মীরগঞ্জে আড়িয়াল খাঁ এর তীরে এক অনুষ্ঠানে সড়ক ও সেতু এবং জ¦ালানী উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান প্রধান অতিথি থাকবেন। নৌ পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) সাখাওয়াত হোসেনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।
প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ‘কেবল স্টেইট এক্সট্রা ডোজ’ টাইপের এ সেতুটি নির্মানে ১ হাজার ৭২ কোটি টাকার দরপ্রস্তাব গত মঙ্গলবার ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদিত হয়েছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রাক-যোগ্যতা সম্পন্ন ৭টি নির্মান প্রতিষ্ঠানের দরপ্রস্তাব সমুহ যাচাই বাছাই এবং আর্থিক মূল্যায়ন শেষে মন্ত্রণালয় হয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ক্রয় কমিটির বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হয়। তবে বাছাইকৃত নির্মান প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রোড এন্ড ব্রীজ করপোরেশন এর সাথে এখনো চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। চলতি মাসের মধ্যেই চুক্তি সম্পাদনের পরে আগামী মাসের মধ্যেই নির্মান প্রতিষ্ঠানটি সরঞ্জামাদী প্রস্তাবিত ব্রীজ এলাকায় সন্নিবেশ করার কথা রয়েছে।
সেতুটি নির্মানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্স-এর একটি যৌথ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার আলোকে ‘এ্যাপ্রাইজাল রিপোটর্’ প্রনয়ন করা হয়।
এক হাজার ৭২ কোটি টাকা ব্যায় সাপেক্ষ মীরগঞ্জ সেতুটি আড়িয়াল খাঁ নদের ওপর তৃতীয় সেতু। অপর দুটি সেতু ঢাকা-ভাঙ্গা-বরিশাল মহাসড়কের শিবচর এবং চাঁদপুর-শরিয়তপুর-মাদারীপুর মহাসড়কে অবস্থিত। মীরগঞ্জ সেতুটি নির্মিত হলে বরিশাল সহ সারা দেশের সাথেই বিচ্ছিন্ন উপজেলা মুলাদী ও হিজলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবার পাশপপাশি পাশ^বর্তি মেহেন্দিগঞ্জের সড়ক পথ অনেকটাই নির্বিঘœ হবে।
এদিকে ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক’এর সভায় মীরগঞ্জ সেতু নির্মানের লক্ষ্যে ‘উন্নয়ন প্রকল্প-প্রস্তাবনা,ডিপিপি’ চুড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। ডিপিপি অনুযায়ী ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও নদী শাসন কাজ সম্পন্ন করে মীরগঞ্জ সেতু যান চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করার কথা রয়েছে। তবে নানা কারণে দরপ্রস্তাব গ্রহণ সহ কার্যাদেশ প্রদানে কিছুটা বিলম্ব ঘটায় সেতুটি চালু করার সময় কিছুটা পিছিয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। সড়ক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকে ৩৬ মাসের মধ্যে সেতুটির নির্মান কাজ শেষ করতে হবে। পরবর্তি ১ বছর নির্মান প্রতিষ্ঠান নিজ দায়িত্বে সেতু ও সংযোগ সড়কের সব ধরনের রক্ষণাবেক্ষন সহ ত্রুটি বিচ্যুতি সমুহ সংস্কার ও মেরামত সম্পাদন করবে।
এক হাজার ৪৮৪ মিটার দীর্ঘ মীরগঞ্জ সেতুটি দৃশ্যত চট্টগ্রাম দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতু ও বরিশালের পায়রা সেতুর আদলে নির্মিত হবে। সেতুর মূল অংশ ২টি এবাটমেন্ট ও এবং ১৭৫ মিটারের দুটি ও ৯৭ মিটারের দুটি পীয়ার সহ ৫৪৪ মিটার। সংযুক্ত ভায়াডাক্ট ৯৪০ মিটার। সেতু ও ভায়াডাক্ট সহ মোট পীয়ারের সংখ্যা থাকছে ৩০টি। সেতুটির দুই প্রান্তে প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হবে। যারমধ্যে টোলপ্লাজার সন্নিকটে রিজিট পেভমেন্ট এবং অবশিষ্ট ৩ হাজার ৯৭৩ মিটার ফ্লেক্সিবেল পেভমেন্ট-এর সড়ক নির্মিত হবে।
নির্মানের পরে খর¯্রােতা আড়িয়াল খাঁ নদের সম্ভাব্য যে কোন ঝুঁকির হাত থেকে সেতুটি রক্ষায় ৪৬০ মিটার নদীতীর রক্ষাকাজে ৯৬.৬১ কোটি টাকা ব্যায় ধরা হয়েছে। এছাড়া সেতুটির প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মানে ২১.৫৫ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহনে ৯৩.৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যদিও সেতুটি নির্মানে ভূমি অধিগ্রহণের জটিল প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। ভূমি অধিগ্রহনে জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সেতুটির নির্মান কাজ শুরু করতে কিছু বাড়তি সময় লাগতে পারে বলেও আশংকা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। বাংলাদেশে যেকোন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় এখনো বছর পার হয়ে যায়। আর ভূমি অধিগ্রহন সম্পন্ন না হলে প্রকল্পটির বাস্তব অবকাঠামো নির্মান কাজ শুরু করা সম্ভব নাও হতে পারে।
প্রকল্পটির আওতায় সেতু ও সংযোগ সড়কে ট্রাফিক সাইন-সিগন্যাল, রোড মার্কিং, টোল প্লাজা, সড়ক বাতি, ব্রীজ স্মার্ট হেলথ মনিটরিং সিস্টেম,বাস-বে, ডিভাইডার, ড্রেন, ফুটপাথ, কালভার্ট ও বনায়ন বাবদও প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যায় হবে বলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্যতা সমিক্ষা ও তার আলোকে প্রণীত এ্যাপ্রাইজাল রিপোর্টে সেতু সংযুক্ত সড়কটিতে বার্ষিক যান চলাচলের হিসেব অনুযায়ী দৈনিক গড়ে প্রায় আড়াই হাজার যানবাহন চলাচল করছে। যা প্রতিবছর গড়ে ১০ভাগ করে বৃদ্ধি পাবে। উপরন্তু সেতুটি নির্মিত হলে সর্বসাধারনের ভ্রমন সময় হ্রাস সহ যানবাহনের পরিচালন ব্যায় বাবদ প্রায় ৪০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি সেতুটি নির্মিত হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বছরে প্রায় ১৯% হতে পারে বলেও সম্ভাব্য হিসেব ধরা হয়েছে।
তবে হাজার কোটি টাকার সম্পূর্ণ দেশীয় তহবিলের বিশাল এ প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে অবিলম্বে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন সহ ভূমি অধিগ্রহনের জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়েছেন সচেতন মহল।