নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশালের বেশিরভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁই ঝুঁকিপূর্ণ
আইন অনুযায়ী সিটি এলাকায় রেস্তোরাঁ চালাতে বাধ্যতামূলকভাবে থাকতে হবে বাণিজ্যিক নিবন্ধন। কিন্তু সেই নিয়মের তোয়াক্কা নেই বরিশাল নগরীতে। নিবন্ধন ছাড়াই নগরজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে একের পর এক হোটেল এবং রেস্তোরাঁ। যেসব প্রতিষ্ঠান মালিকদের অনেকেই জানেন না হোটেল বা রেস্তোরাঁ চলাতে নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা।
সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে- ৫৮ বর্গ কিলোমিটারের এই নগরীতে নিবন্ধনভুক্ত হোটেল-রেস্তোরাঁ রয়েছে ৫৫৫টি। তবে বেসরকারি হিসেবে সেই সংখ্যা হাজারের ওপর। বৈধ এবং অবৈধ রেস্তোরাঁগুলোর বেশিরভাগেই নেই বাণিজ্যিক লাইসেন্স, অগ্নি নিরাপত্তা এবং বাহির হওয়ার বিকল্প পথ।
যার মধ্যে রয়েছে- নগরীতে রয়েছে নানান দেশী-বিদেশী খাবার পরিবেশনকারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে যেকোনো সময় ঘটতে পারে রাজধানীর বেইলি রোডে ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরাঁর মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এ শঙ্কা ক্রমশ জটিল হলেও বিষয়টি মাথা ব্যথার কারণ হচ্ছে না জেলা প্রশাসন বা নগর কর্তৃপক্ষের।
যদিও সিটি এলাকায় সকল আবাসিক হোটেল এবং রেস্তোরাঁগুলোতে চিরুনি অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যা আগামী সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হবে। অভিযানকালে ঝুঁকিপূর্ণ হোটেল এবং রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও নেওয়া হতে পারে বলে জানান তারা।
বরিশাল জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সূত্র মতে, এক ও দুই তারকা মানের হোটেল ও রেস্তোরাঁর নিবন্ধন দিয়ে থাকে জেলা প্রশাসন। তিন থেকে পাঁচ তারকা মানের হোটেল দিতে নিতে হবে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন। তবে বরিশাল নগরীতে তারকা মানের কোন হোটেল নেই বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট শাখা।
জানা গেছে, ‘হোটেল এবং রেস্তোরাঁ চালু করতে নিতে হয় সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, স্যানেটারি লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং ফায়ার সার্ভিসের সনদ। এসব প্রস্তুতির পর সনদ পেতে আবেদন করতে হবে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে। কিন্তু লাইসেন্স পেতে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে বেশিরভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক নিচ্ছেন না রেস্তোরাঁর নিবন্ধন।
তবে বৈধ হোটেল রেস্তোরাঁর পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাধারণ শাখা থেকে। এ বিষয়ে তথ্য দিতে অপরাগত প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। বরিশাল সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে, তাদের অধীনস্থ ৩০টি ওয়ার্ডে মোট ৫৫৫টি রেস্তোরাঁ রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় দুইশর মতো রয়েছে চাইনিজ মানের রেস্তোরাঁ। এর বাইরে নিবন্ধন এবং ট্রেড লাইসেন্স বিহীন হোটেল-রেস্তোরাঁর সংখ্যা হাজারের ওপর বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
বরিশাল হোটেল-রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সংগঠনের সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, তাদের সংগঠনে ১৫০টির মতো হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং মিষ্টির দোকান রয়েছে। যার মধ্যে ১২০টিই হোটেল-রেস্তোরাঁ। তাদের সমিতিতে থাকা অধিকাংশ হোটেল এবং রেস্তোরাঁর সনদ নেই বলে স্বীকার করেছেন নুরুল ইসলাম। তবে তার মালিকানাধীন আকাশ হোটেল এন্ড রেস্তোরাঁর সব ধরনের লাইসেন্স রয়েছে বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ী সংগঠনের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, প্রায় সময় জেলা প্রশাসন এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে। তবে তারা নিবন্ধনের বিষয়টিতে কখনোই গুরুত্ব দেননি। পরিবেশ এবং খাবারের মানের ওপরেই তদারকি করছেন। ফলে নিবন্ধনের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে না ব্যবসায়ীরা।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স বরিশাল জেলার ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর মো. আব্বাস উদ্দিন জানান, বরিশাল নগরীতে আবাসিক ভবনে ৪১টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এর বাইরে আরো একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার অনেকগুলোতেই নেই অগ্নি নিরাপত্তা বা প্রয়োজনীয় নিবন্ধন। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের প্রবেশ পথই ছোট। তার ওপর বাহির ওয়ার জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থাও নেই।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে সদর রোডে আবাসিক হোটেল এরিনার নবম তলা ও ছাদে অবস্থিত ‘হান্ডি কড়াই’ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এ প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত নকশার সাথে ভবনের মিল নেই। এখানে প্রবেশ করতে হয় লিফটে। সিঁড়ি থাকে আটকানো। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে মানুষের বের হওয়ার যায়গা পাবে না। তাছাড়া ৬ তলার ওপর আগুন নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা বরিশাল ফায়ার সার্ভিসের নেই। এসব কারণে ‘হান্ডি কড়াই’সহ ৬ তলা ভবনের ওপরে সকল রেস্তোরাঁই আমাদের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে।
এদিকে সম্প্রতি নগরীর রূপাতলী এলাকায় আবাসিক ভবনে সুগারি পেস্ট্রি ও ডাইন বিস্ট্রো নামের রেস্টুরেন্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রেস্টুরেন্টটিতে কাস্টমার না থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটলেও রেস্টুরেন্টের ভেতরের অংশ পুড়ে গেছে। বিএম কলেজ ছাত্রী আহত হয়েছে। নতুন চালু হওয়া এই প্রতিষ্ঠানটিরও কোন নিবন্ধন ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক বেলাল উদ্দিন জানান, ঢাকার বেইলি রোড ট্রাজেডির পর পরই সিটি মেয়র এবং জেলা প্রশাসক এবং আমাদের ফায়ার সার্ভিসের ডিডি মহোদয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী আমরা তদারকিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছি। এরই মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান আমরা পরিদর্শন করেছি। কিছু অসঙ্গতি পেলেও বড় ধরনের কোন অনিয়ম পাওয়া যায়নি। তবে আমাদের নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তাই মোবাইল কোর্ট করতে পারছি না। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সমন্বয়ে চিরুনি অভিযান পরিচালিত হবে। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বরিশালের জেলার স্থানীয় সরকার পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক গৌতম বাড়ৈ বলেন, আমাদের অভিযান সবসময়েই চলছে। তবে ডিসি স্যার সম্মেলনে অংশ নিতে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি আসার পরে এ বিষয়ে আরো জোরালো অভিযান পরিচালিত হবে।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের সভাপতিত্বে সিটি পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, হোটেল-রেস্তোরাঁর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি। নতুন ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে অবশ্যই ফায়ার সার্ভিসের ছাত্রপত্র থাকার বিষয়টিতে কঠোর হওয়ার বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। পাশাপাশি নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ে অভিযান পরিচালনার বিষয়েও মেয়র আলোচনা করেন বলে জানিয়েছেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা আহসান উদ্দিন রোমেল।