ঢাকাবুধবার , ১০ জুলাই ২০২৪
আজকের সর্বশেষ সবখবর

দেশের উত্তরাঞ্চলে বানভাসিদের দুর্ভোগ, মেলেনি পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
জুলাই ১০, ২০২৪ ৫:০৯ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিউজ ডেস্ক :: দেশের উত্তরাঞ্চলে বানভাসিদের দুর্ভোগ, মেলেনি পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা

 

‘ওমরা যে চাল দিয়ে যাচ্ছে, সেল্লা (সেগুলো) মানুষ খাওয়ার জন্য লয়। এল্লা হাঁস-মুরগির খাবার। এল্লার থেকে এনা চিড়া আর গুড় দিলে পানি দিয়ে খাওয়া যায় হে সেল্লা না করে দুই-তিন কেজি করে চাল দিয়ে বারেবার ক্যামের দিকে তাকবার কয় আর ফডো তোলে।’ কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চরকাপাসিয়া গ্রামের ময়না বেওয়া। একই গ্রামের মইনুল ইসলামের দাবি, বন্যায় পর্যাপ্ত শুকনো খাবার প্রয়োজন। এগুলো না দিয়ে শুধু দু-তিন কেজি করে চাল দিয়ে যাচ্ছে

দেশের উত্তরাঞ্চলে বানভাসিদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। কিন্তু মেলেনি পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা। বেড়িবাঁধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেওয়া বন্যার্তরা এখনো নিজেদে বাড়িঘরে ফিরতে পারেনি। দীর্ঘদিন পানিতে ডুবে থাকায় অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়ছে। দুর্গত এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে চর্মসহ পানিবাহিত রোগ। কেউ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসবে বলে নদীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ। এদিকে গাইবান্ধা ও জামালপুরে বন্যার পানিত ডুবে গতকাল মঙ্গলবার তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি দুর্দশায় পড়েছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তিস্তা পাড়ের মানুষ। পথঘাট ডুবে যাতায়াতের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে বানভাসিদের। ভরসা একমাত্র নৌকা কিংবা ভেলা। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি, কোথাও বা বুকসমান পানি থাকায় রান্না করারও  বেলা আহার জুটলেও জোটে না আরেক বেলা। অনেককেই শুকনো খাবার খেয়েই কাটিয়ে দিতে হচ্ছে দিনরাত। টিউবওয়েলগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। পরিবার-পরিজন ও হাঁস, মুরগি এবং গবাদি পশু নিয়ে মহাবিপদে পড়েছে বানভাসিরা। এ অবস্থায় ত্রাণের আশায় তিস্তার দুই তীরে অপেক্ষমাণ থাকতে দেখা যায় বিভিন্ন বয়সী নারী, পুরুষ ও শিশুকে। কেউ গামলা, কেউ বালতি, কেউ পাতিল, আবার কেউ বা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুর্দশা লাঘবে নৌকা ভরে ত্রাণ নিয়ে আসবে বলে। নৌকা কাছাকাছি এলে পানিতেও নামছে কেউ কেউ। এদিকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে কাওসার আহমেদ নামে দুই বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার বেলকা ইউনিয়নের তালুক বেলকা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে টাঙ্গাইলের পাঁচটি উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ জনপদের বাড়িঘর, হাটবাজার, মসজিদ, মন্দির, ফসলি জমিসহ অন্যান্য স্থাপনা। ১০৮টি গ্রামে নতুন করে বন্যা দেখা গিয়েছে। দুর্গম চরাঞ্চলের এসব গ্রামের ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কোথাও অবনতি এবং কোথাও অপরিবর্তিত রয়েছে। ভূঞাপুর উপজেলার ৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, নিচু ও চরাঞ্চল এলাকার বন্যাকবলিত মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

গত এক সপ্তাহে কুড়িগ্রামে বন্যার পানির নিচে তলিয়ে আছে সবজি ও আমন বীজতলাসহ ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল। উলিপুর উপজেলার কলাতিপাড়া গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি ৫ বিঘা জমিতে মরিচ লাগিয়েছিলেন। শুধু ৩০ কেজি মরিচ বিক্রি করতে পেরেছেন। মরিচ ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। এ বছর ৪ লাখ টাকার মরিচ বিক্রির পরিকল্পনা ছিল তার।

চিলমারী উপজেলার জোরগাছ গ্রামের কৃষক সুধীর চন্দ্র দাস বলেন, বন্যার পানির নিচে তলিয়ে থাকায় তার ৪০ শতাংশ জমির আমন বীজতলা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যার পানি নেমে গেলে ফের বীজতলা প্রস্তুত করতে হবে। কবে বন্যার পানি নামবে—সে আশায় দিন গুনছেন তিনি।

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পানি তিন থেকে চার দিনের মধ্যে নেমে গেলে ফসল কিছুটা রক্ষা হবে। কৃষি বিভাগের লোকজন এখনো মাঠপর্যায়ে ফসলের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করছেন।

চিলমারী উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল নয়ারহাট ইউনিয়নে পানিবন্দি কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য রোববার জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা বিতরণ করে একটি বেসরকারি সংগঠন। অনুদানের টাকা ভাগাভাগি করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ইউপি সদস্য আ. সাত্তারের বিরুদ্ধে। টাকা বিতরণের সময় সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। কিশোরীরা জানায়, তাদের টাকা দেওয়ার সময় স্থানীয় শওকত আলী তাদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে নেন। সুমি আক্তার, নদী আক্তার, মাসুমা খাতুনসহ বেশ কয়েকজন কিশোরী জানায়, তালিকায় তাদের নাম থাকলেও তারা টাকা পায়নি।

জামালপুরে ৪১ ইউনিয়নে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি মানুষ। সুপেয় পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। জামালপুর শহরেও পানিবন্দি সাড়ে ১২ হাজার বাসিন্দা। মেলান্দহে বন্যার পানিতে ডুবে সোহেল (২২) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার নইলাঘাট এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে পানিতে গোসল করতে গিয়ে নিখোঁজ হয় সে। পরে তার লাশ উদ্ধারে করে ফায়ার সার্ভিস। এদিকে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চর বাহাদুরাবাদ আজিজলপুর গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে আরিফা (৬) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে ওই গ্রামের আলম মিয়ার মেয়ে। গতকাল বিকেলে এ ঘটনা ঘটে।

এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ৪৮ হতে ৭২ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এই সময়ে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার—এই তিন নদীর পানি বাড়বে। তবে যমুনা নদীর পানি ধীরগতিতে কমবে। গতকাল বিকেল ৩টায় দেশের আটটি নদীর ১৮টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছিল।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র আরও জানায়, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি কিছু পয়েন্টে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হতে পারে। তবে পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সময় বিশেষে দ্রুত বাড়তে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি বাড়ছে, অন্যদিকে পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় দুই নদীর পানি বাড়তে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ‘উন্নতির দিকে যাচ্ছে, তবে দুদিন উত্তরাঞ্চলে কিছুটা অবনতি হতে পারে, ব্যাপক অবনতি হবে না। বৃষ্টিপাতের স্কেলটা চলে গেলে আবার উন্নতি হবে।’

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আজ বুধবার রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে।