নিজস্ব প্রতিবেদক :: যমুনার তেল নিয়ে তেলেসমাতি : ২৮ হাজার লিটার ডিজেল কালোবাজারে বিক্রি
যেখানে দায়িত্ব পেয়েছেন, সেখানেই জ্বলেছে লাল বাতি! প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ গোল্লায় গেলেও নিজে উঠেছেন ফুলেফেঁপে। তিনি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিপণন প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ডিপো সুপারিনটেনডেন্ট এ কে এম জাহিদ সরওয়ার। খুলনার মোংলা ডিপো দেখেছে তাঁর সর্বশেষ তেলেসমাতি! তাপমাত্রাজনিত অপারেশনাল ক্ষতি দেখিয়ে জাহিদের বিরুদ্ধে প্রায় ২৮ হাজার লিটার ডিজেল কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য যমুনা অয়েলে আগে থেকেই তিনি ‘তেলখেকো’ নামে পরিচিত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মোংলা ডিপোয় থাকাকালে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন জাহিদ। চলতি বছরের ২৬ মে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। কিন্তু তিনি রিমালের কারণে ক্ষতি দেখিয়েছেন জুন মাসে। মোংলা অয়েল ইনস্টলেশন ডিপোতে মাসিক লাভ-ক্ষতির হিসাবে তেল বিক্রির পরিমাণ পরিবর্তন করে জাহিদের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
লাভ-ক্ষতির বিবরণে দেখা যায়, জুনে প্রথমে বিক্রি দেখানো হয় ১ লাখ ২৬ হাজার ৪০০ লিটার। এর মধ্যে অপারেশনাল ক্ষতি ১ হাজার ৫৯০ ও তাপমাত্রাজনিত (৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) ক্ষতি হয় ৭১৮ লিটার।
তাপমাত্রার হেরফেরে জ্বালানি তেলের ঘনত্ব বাড়ে-কমে। এটিকেই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগান জাহিদের মতো অসাধু কর্মকর্তারা। মোংলা ডিপোতে চুরি ধরা পড়ার পর জাহিদ জুনের বিক্রির সঙ্গে ক্ষতি সমন্বয় করেন। একটি সংশোধনীতে দেখানো হয়, জুনে জ্বালানি তেল বিক্রি ৯৯ হাজার লিটার। এর মধ্যে তাপমাত্রাজনিত ক্ষতি ২৭ হাজার ৯৪১ লিটার। মূলত এভাবে পুরো তেল ‘হাওয়া’ দেখিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করেন জাহিদ। পরে আত্মসাৎ করা তেলের পরিমাণে সামঞ্জস্য রাখতেই জুনে প্রতিদিন বিক্রিতে ক্ষতি দেখানো হয়।
সূত্র জানায়, জাহিদের হিসাব নিয়ে খটকা থাকায় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি। এর পর প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এক পর্যায়ে সমালোচনার মুখে ডিপো থেকে প্রত্যাহার করে গত সেপ্টেম্বরে জাহিদকে কোম্পানির চট্টগ্রামের প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। অভিযোগ মাথায় নিয়ে সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিতরণ) পদে পদোন্নতি পান। তেলে ভেজাল করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও তিনি ভালো জায়গায় পদায়নের জন্য তদবির করছেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, ২০০৬ সালে যমুনার ফতুল্লা ডিপোতে সিনিয়র অপারেশনাল অফিসার থাকাকালে জাহিদ সাময়িক বরখাস্ত হন। ডিপোতে বিভিন্ন অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও কোম্পানির স্বার্থ পরিপন্থি কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে এ শাস্তি দেওয়া হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করে যমুনা অয়েল। এখানেও জালিয়াতি করে জাহিদ একই পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিল একাধিকবার নিয়েছেন। নিয়মবহির্ভূতভাবে মায়ের চিকিৎসা বিল তুলে মেরে দিয়েছেন। এ নিয়েও জাহিদ আরেকবার শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন।
যমুনার তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানের বাঘাবাড়ী ডিপোতে ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন জাহিদ। এ সময়ে কোম্পানির সবচেয়ে বেশি অপারেশনাল লোকসান হয়, যা শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে তাঁকে বদলি করে এবং পরবর্তী তিন অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ কমে শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশে আসে।
এ ছাড়া ২০২১ সালের শুরুতে যমুনা অয়েলের বাঘাবাড়ী ডিপোর কর্মকর্তা হিসেবে জাহিদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও বাজে আচরণের প্রতিবাদে ট্যাঙ্কলরি চালকরা তেল পরিবহন বন্ধ করে দেন। এতে উত্তরবঙ্গে জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। কিন্তু এ তথ্য কোম্পানিকে জানাননি জাহিদ। পরে জানাজানি হলে তাঁকে প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু দেড় মাস না যেতেই তিনি বাঘাবাড়ীর মতো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খুলনার মোংলা ডিপোতে পোস্টিং নেন ১৮ মে। অভিযোগ রয়েছে, এ পোস্টিংয়ের জন্য জাহিদ কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দেন। আগে মোংলা ডিপো লাভে থাকলেও জাহিদ যাওয়ার পর থেকে প্রতিবছর লোকসান দিয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জাহিদ সরওয়ার সমকালকে বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আমি আমার জবাব দিয়েছি। কিছু বলার থাকলে তারাই বলবে। আমি কোনো মন্তব্য করব না।’
পরে যমুনা অয়েলের মহাব্যবস্থাপক মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি জানা নেই বলে এড়িয়ে যান। কোম্পানির অপারেশন্স শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) হেলাল উদ্দিনের নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি।