
নিজস্ব প্রতিবেদক :: কর্মস্থলমুখী জনস্রোতে পা রাখার ঠাঁই নেই বরিশালের নৌ ও বাস টার্মিনালগুলোতে। রোববার ঈদ-উল-আজহা পরবর্তি প্রথম কর্মদিবসের আগেই কর্মস্থলে ফিরতে শ্রমজীবী ও কর্মজীবী মানুষের স্র্রোত এখন রাজধানী ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে।
দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম বরিশাল নদী বন্দর থেকে গত কয়েকদিন ধরেই ৮ থেকে ১০টি বড় মাপের যাত্রীবাহী নৌযান ধারণক্ষমতার ২-৩ গুন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। আরো কিছু নৌযান বরিশাল ছুয়ে চাঁদপুর হয়েও ঢাকায় পৌঁছছে। এসব যাত্রীরা চাঁদপুর পৌঁছে সেখান থেকে ট্রেনে করে পৌঁছছেন চট্টগ্রামে। বিপুল সংখ্যক যাত্রী বরিশাল থেকে নৌপথে ইলিশাঘাট হয়ে মজুচৌধুরীর হাট পৌঁছে সেখান থেকে সড়ক পথেও চট্টগ্রাম অঞ্চলে যাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি নৌপথই এখন জনস্রোতে পরিপূর্ণ। ঈদের আগের ৫ দিনও ঢাকা থেকে প্রতিদিন ৫-৭টি বেসরকারি নৌযানে বিপুল সংখ্যক মানুষ বরিশালে পৌঁছেছেন। আগের ৩টি দিন ৯-১০টি নৌযান প্রতিদিন ডবল ট্রিপে যাত্রী নিয়ে বরিশালে পৌঁছেছে। এবারের ঈদের আগে পরেও ঢাকা ও চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে কমবেশি যে ১০ লাখ মানুষ বরিশাল সহ সন্নিহিত এলাকায় যাতায়াত করছেন, তার অন্তত ৯ লাখই নৌপথে ভ্রমণ করেছেন বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।
এমনকি ঈদ-উল-ফিতরের মতো ঈদ-উল-আজহাতেও বরিশাল অঞ্চলের ঘরেফেরা ও কর্মস্থলমুখী মানুষের জন্য নৌপথই প্রধান ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে এবারই প্রথম রাষ্ট্রীয় নৌ-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান-বিআইডব্লিউটিসি রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর সহ দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সাথে বরিশাল অঞ্চলের কোনো যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিস পরিচালন করেনি।
রাষ্ট্রীয় সড়ক পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি’ও তার পুরনো কিছু যাত্রীবাহী বাসের সাহায্যে সম্ভব সর্বোচ্চ ট্রিপে যাত্রী পরিবহন করলেও তা ঈদ কেন্দ্রীক যাত্রীদের খুব বেশী উপকারে আসেনি। ফলে বরিশাল অঞ্চলের মানুষ বেসরকারী সড়ক ও নৌপরিবহন সেক্টরের মর্জির ওপরই নির্ভরশীল আছে। জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঈদের আগে পরে ব্যাপক জন চাহিদার মধ্যেও স্বেচ্ছা অন্ধত্বেই ভুগছে।
আগামী শনিবার পর্যন্ত বরিশালসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল থেকে কর্মস্থলমুখী এ জনস্রোত অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকগণ। ২০২২-এর জুনে পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে রাজধানীর সাথে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌযোগাযোগের গুরুত্ব অনেকটাই গৌন হয়ে পরে। অনেকে নৌপথের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে সড়কপথমুখী হলেও তার চেয়ে অপপ্রচারণা ছিল বেশী।
ফলে একের পর এক বিলাসবহুল নৌযান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক নৌযান স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রিও হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কোনো কোনো নৌযানের মালিক ব্যাংকের দেনা শোধ করতে গিয়ে যেমনি পথে বসে গেছেন, তেমনি নৌপথের ওপর নির্ভরশীল অন্তত ৫০ হাজার কর্মজীবী ও শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। শুধু বরিশাল-ঢাকা নৌপথে রুট পারমিটধারী প্রায় ২৯টি নৌযানের মধ্যে এখন অন্তত ১০টির কোনো হদিস নেই। তবে ঢাকাসহ দেশের পূর্ব, পূর্ব-উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বের সাথে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ রক্ষাকারী অপ্রশস্ত বরিশাল-ভাঙ্গা ৯১ কিলোমিটার অপ্রশস্ত মহাসড়কটি অতিক্রমে এখন ৪ ঘণ্টাও সময় লাগছে।
১৮-২৪ ফুট প্রশস্ত ঐ মহাসড়কের তুলনায় যানবাহনের আধিক্য যাত্রীদের দুর্ভোগের সাথে নিরাপত্তাও বিঘিœত করছে। উপরন্তু মহাসড়কটির দুপাশের অবৈধ দখলদারী যানবাহনের নির্বিঘœ চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে ঈদের আগের পরের বাড়তি যানবাহনের চাপে গত দিনদশেক যাবত এ মহাসড়কটিতে দুর্ঘটনা নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহ জুড়েই বরিশাল-ফরিদপুর মহসড়কটির বরিশাল-ভুরঘাটা ও ভুরঘাটা-ভাঙ্গা অংশে বারবারই দুর্ঘটনায় সড়ক যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
প্রতিদিনই এ মহাসড়কে ৩-৪ ঘণ্টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকছে। তবে বিগত দুটি ঈদকে কেন্দ্র করে বরিশালসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়েই সাধারণ মানুষ কর্মস্থলে ফিরতে নৌযানকেই নিরাপদ ও তুলনামূলকভাবে ব্যয় সাশ্রয়ী সহ নির্বিঘেœ গন্তব্যে পৌঁছার নির্ভরযোগ্য বাহন মনে করছেন। ঈদের আগে পরের স্বল্পতম সময়ে দশ লাখ যাত্রী বহনের সক্ষমতা দেশের কোনো সড়ক পথের নেই । ফলে সবার কাছেই নৌপথই প্রধান এবং নির্ভরযোগ্য ও অপরিহার্য অবলম্বন বলে অকপটে আরো একবার স্বীকার করে নিচ্ছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞগণও।
তবে নৌপথে এখনো বেশকিছু বিড়ম্বনা যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে চলেছে। বিশেষ করে ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে সদরঘাটে পৌঁছার বিড়ম্বনা এখনো যাত্রী সাধারণকে নৌপথে ভ্রমণে অনাগ্রহী করছে। বরিশাল থেকে নৌযানগুলো প্রত্যুষে ঢাকা পৌঁছে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়ার পরেই পুরো সদরঘাট এলাকায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা চরম বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এরসাথে বরিশাল ও ঢাকার সদরঘাট নৌ টার্মিনালে ব্যাগেজ নিয়েও ঘাট শ্রমিকদের অত্যাচারে প্রতিনিয়ত হেনস্থা হতে হচ্ছে যাত্রীদের।
এমনকি বরিশাল ও ঢাকার নৌ টার্মিনাল দুটিতে গাড়ী পার্কিং থেকে শুরু করে যাত্রীদের ন্যূনতম কোনো সুযোগ-সুবিধাও অনুপস্থিত। এসব টার্মিনালে অসুস্থ রোগীদের পরিবহনে কোনো সচল স্ট্রেচার ও হুইল চেয়ার পর্যন্ত নেই। পাশাপশি বরিশাল টার্মিনালের গ্যাংওয়ে এবং অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট ছাড়াও গাড়ী পার্কিংসহ নানা অব্যবস্থাপনায় ভোগান্তিও শুধু বাড়ছে। যা যাত্রীদের নৌপথে ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করছে। এরসাথে যুক্ত হয়েছে টার্মিনাল ফি। রেল ভ্রমণে যেখানে যাত্রীদের কোনো টার্মিনাল ফি দিতে হয় না, সেখানে নৌ টার্মিনালে প্রবেশ করতেই যাত্রীপিছু টার্মিনাল ফি এখন ১০ টাকা।
যা পদ্মা সেতু চালুর আগে ছিল ৫ টাকা। স্বাধীনতার পরে ছিল ১০ পয়সা। অপরদিকে বিপুল সম্ভাবনা ও নির্ভরতার নৌপথে রাষ্ট্রীয় নৌ-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, বিআইডব্লিউটিসি’র অবহেলা ও উদাসীনতাও সাধারণ মানুষকে নৌপথ বিমুখ করে তুলছে। ‘জনগণের নিরাপদ নৌভ্রমণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব’ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রীয় নৌ-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৭টি যাত্রীবাহী নৌযান থাকার পরেও গত কয়েকটি বছর ধরে সংস্থাটি রাজধানীর সাথে দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপদ যাত্রী পরিবহনে চরম উদাসীন।
এমনকি গত কয়েকটি বছর ঈদের আগে পরে সংস্থাটি সীমিত কিছু স্টিমার সার্ভিস পরিচালন করলেও এবার পুরোপুরি হাত গুটিয়ে বসে আছে। তবে এসব কিছুর পরেও এখনো রেল যোগাযোগবিহীন দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থায় নৌপথের গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। বরিশালের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি, সরকারি-বেসরকারি কর্মী ও গণমাধ্যম কর্মীগণও রাজধানীরসহ সারা দেশের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নৌ পরিবহনের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন।
তাদের মতে কোনো দেশ বা অঞ্চলে কখনোই একমুখী পরিবহন ব্যবস্থা জনগনের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে পারেনা। এক্ষেত্রে সড়ক পরিবহনের পাশাপাশি অবশ্যই নৌ যোগাযোগকেও যথাযথ গুরুত্ব প্রদানের তাগিদ দিয়েছেন ওয়াকিবহাল মহল।
একইসাথে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাড়কটির বরিশাল-ভাঙ্গা অংশ ৬ লেনে উন্নীতকরণের প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নসহ প্রস্তাবিত বরিশাল-ভাঙ্গা রেলপথ নির্মাণ ও বরিশাল সেক্টরে নিয়মিত বিমান ফ্লাইট পুনর্বহালেরও দাবি জানান হয়েছে সর্ব মহল থেকে।