
নিজস্ব প্রতিবেদক :: ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটে বিলাসবহুল লঞ্চে য*ন্ত্র*পা*তি অত্যাধুনিক : তবুও ঘটছে দু*র্ঘ*টনা।
১৭০ কিলোমিটার বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে বর্তমানে চলাচলকারি যাত্রিবাহী প্রতিটি লঞ্চই সর্বোচ্চ বিলাসবহুল। এ লঞ্চ চালনায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলোও অত্যাধুনিক। কিন্তু এসব যন্ত্রপাতি চালনার জন্য সংশ্লিষ্টদের কোন প্রশিক্ষন না থাকায় প্রায়শই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রশিক্ষনের তাগিদ খোদ কর্তৃপক্ষেরও। তবে উদ্যোগ নেই কারো।
পঞ্চাশের দশকে বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে ঘন্টা পিটিয়ে যাত্রিবাহী লঞ্চ চালনা শুরু হয়। এখন বিলাসবহুল লঞ্চগুলো চালানো হয় রাডার, ইন্ডিকেটর, রিমোট কন্ট্রোল, ইকো সাউন্ডার, জিপিএস ও ভিএইচএফ এর মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে। তার পরেও রাত্রিকালীন এসব লঞ্চে দুর্ঘটনা লেগেই আছে। যারা এসব আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে লঞ্চ চালায় তাদের দাবি এ বিষয়ে তারা কোনদিন কোন প্রশিক্ষন পায়নি। দেখে দেখে এসব যন্ত্র তারা চালাচ্ছেন। চালক আবুল কালাম বলেন, ঘন্টি ব্যবহার করে চঞ্চ চালনা শুরু করি। এখন লঞ্চ চালাই রিমোট দিয়ে। এখন রাডারসহ সব কিছুই আছে। কুয়াশায় আমাদের ফগ লাইট নাই, আমরা রাডারে চলি। কিন্তু এসব যন্ত্রপাতি চালনায় আমাদের কোন প্রশিক্ষন নেই, চালাতে চালাতে শিখেছি।
সুকানি আব্দুর রহিম বলেন, আমি জাহাজ চালাই ৩৩ বছর থেকে। এতো বছরেও আমাদের কোন প্রশিক্ষন দেয়া হয়নি। এখন জাহাজের আধুনিক যন্ত্র চালাই আন্দাজে। দেখে দেখে চালাতে হয়। আমাদের প্রশিক্ষন দেয়া হলে ভালো হয়।
বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে মেঘনাসহ অন্তত ৬টি বড় নদী পাড়ি দিতে হয় চালকদের। ৭ থেকে ৯ ঘন্টার এ যাত্রাপথে যাত্রি নিয়ে বর্তমানেও ঢাকা থেকে দক্ষিণে প্রতিরাতে ২৮ থেকে ৩০টি বড় লঞ্চ চলাচল করে। চালকদের কারো কারো মতে কুয়াশা কিংবা ঝড়ের রাতে এর একটি যন্ত্র কাজ না করলে বিকল্প কিছু করার ব্যবস্থা নেই। কার কথা কাকে বলা হচ্ছে বা কে শুনছে তা জানার জন্য কথকথন যন্ত্রে কোন ডিসপ্লে নেই। তাছাড়া নদীতে এনালগ নৌ যানও চলছে অনেক। এ কারনে নির্দেশনার ভুল বোঝাবুঝির কারনে ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনা।
লঞ্চ মাস্টার মোতালেব হোসেন বলেন, মেঘনার মাঝের চর অতিক্রমকালে কুয়াশার মধ্যে একসাথে শতাধিক জাহাজ চলাচল করে। এসময় ভিএইচএফ এ একের কথা অন্যে বুঝতে পারে না। এছাড়া ভিএইচএফ অনেক সময় অকার্যকর হয়। এরজন্য বিকল্প কিছুই নেই। এতে ডিসপ্লে না থাকায় কে কার সাথে কথা বলছে বোঝা যায় না। এতে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি হয়।
সুপারভাইজার বেল্লাল বলেন, ভুল বোঝাবুঝির কারনেই দুর্ঘটনা ঘটছে। নদীতে চর থাকায় সীমিত পথ দিয়ে জাহাজ চালাতে হয়। সবাই চ্যানেল সাইডে থাকতে চায়। এ সময় নির্দেশনার ভুল হলেই দুর্ঘটনা ঘটে।
নদীতে যাত্রিবাহী জাহাজগুলো ডিজিটাল হলেও এখন অনেক এনালগ নৌযান চলাচল করছে। আপনি যতই রার্ডার দেখে জাহাজ চালাননা কেন বিপরীতের জাহাজ এনালক হলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
২০২৪ সালের প্রথম দুর্ঘটনা ঘটে চাঁদপুরে সুন্দরবন-১৬ লঞ্চ আর বিপরীতের একটি কার্গোর সাথে সংঘর্ষের মাধ্যমে। সর্বশেষ গত ২২ ডিসেম্বর কীর্তনখোলা-১০ ও প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চের মধ্যে সংঘর্ষ মধ্যে ঘটে একই ঘটনা। এ নিয়ে এ বছর অন্তত ৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। প্রতিটি ঘটনায় অল্পের জন্য প্রানে বেঁচেছেন হাজার হাজার যাত্রি। খোদ লঞ্চ কর্তৃপক্ষের দাবি হলো জাহাজ চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষন দেয়ার।
সুন্দরবন গ্রুপের ম্যানেজার জাকির হোসেন বলেন, লঞ্চ চালনার পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে। বৈরি আবহাওয়া ও কুয়াশায় অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। মালিক পক্ষ একটা বড় অংকের বিনিয়োগ করে লঞ্চ নামায়। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের উচিৎ চালক-সুকানিদের জন্য প্রতি বছর নিয়মিত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা।
বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে অন্তত দেড় শতাধিক মাস্টার সুকানি রয়েছেন যাদের অধিকাংশেরই আধুনিক লঞ্চ চালনার প্রশিক্ষন নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি হলো চালক ও সুকানিরা সরকারি নির্দেশ না মানায় দূর্ঘটনা ঘটছে বলে । তবে তারা দ্রুত প্রশিক্ষনের উপর গুরুত্ব আরোপও করেছেন।
বরিশালের বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, শীতে কুয়াশার সময় কিভাবে লঞ্চ চালাতে হবে তা আমরা আগে থেকেই চিঠি দিয়ে লঞ্চগুলোকে জানিয়েছি। কুয়াশায় ১০০ মিটারের মধ্যে কিছু দেখা না গেলে লঞ্চ বন্ধ রাখার ও ঘন ঘন হর্ন বাজানোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সচেতনতার অভাবে লঞ্চ চালকরা এ নির্দেশনা মানছে না বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরাও মনে করি মাস্টার সুকানিসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রশিক্ষন দেয়া দরকার। সমস্যা হলো এখন যারা লঞ্চ চালাচ্ছে তারা অনেক প্রবীন, আধুনিক মেধা এদের অনেক কম। তবে দ্রুত লঞ্চ চালক ও সুকানিদের প্রশিক্ষনের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন।


