
নিজস্ব প্রতিবেদক ::: বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের নয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগ কর্মী শাখাওয়াত হোসেন মনির নিজেকে বিএনপি বানাতে মরিয়া হয়েছে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার এ কাজে সহায়তা করছে বরিশাল জেলা ও সদর উপজেলা বাস্তুহারা দলের কয়েকজন নেতাকর্মী। রাতারাতি পূর্বের কমিটিতে থেকে একজন যুগ্ম আহবায়কের নাম কেটে সেখানে শাখাওয়াত হোসেন মনিরের নাম বসিয়ে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ একাধিক নেতাকর্মীর। শাখাওয়াত হোসেন মনিরের সকল কার্যক্রমে বরিশাল জেলা বাস্তুহারা দলের সভাপতি জসিম উদ্দিন মিলনের সরব উপস্থিতি নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে যে, কমিটির অন্যান্য নেতাকর্মী তার কার্যক্রমে অংশ না নিলেও কি কারণে জেলা বাস্তুহারা দলের সভাপতি মিলন তার সকল কার্যক্রমে অংশ নেয়?।
গত সোমবার দুপুর আড়াইটায় বরিশাল প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলন করেন শাখাওয়াত হোসেন মনির। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন- চরকাউয়া নয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয় এডহক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে একটি পক্ষ। আমাকে পুরোপুরি আওয়ামী লীগ সাজিয়ে গত ১৬ এপ্রিল নতুন বাজার আমার নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বিএনপির অফিস পোড়ানোর ঘটনায় মহানগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগরে প্রেরণ করা হয়। এ সময় তিনি ওই বিদ্যালয়ের বর্তমান এডহক কমিটির সভাপতি পূর্ণিমা সরদার এ সকল ঘটনায় জড়িত বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, মিথ্যা অভিযোগে আমাকে কারাগারে পাঠানোর পর পরই স্কুল কমিটিতে আরেকজন মহিলাকে সভাপতি করা হয়েছে। যার স্বামী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। এখন স্থানীয় একটি মহলের সহযোগিতায় আমাকে আওয়ামী লীগ সাজিয়ে স্কুল কমিটি থেকে বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে।
এ বিষয়ে পূর্ণিমা সরদার বলেন- শাখাওয়াত হোসেন মনিরের অভিযোগের বিষয়টি হাস্যকর। আমি চরকাউয়া নয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয় এডহক কমিটির সভাপতি পদের জন্য কাগজ জমা দিয়েছিলাম। প্রথমে শিক্ষা বোর্ড শাখাওয়াত হোসেন মনিরকে সভাপতি নির্বাচিত করেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগ করায় বিএনপির অফিস পোড়ানোর মামলায় কারাগারে গেলে শিক্ষা বোর্ড তালিকার পরবর্তী প্রার্থী হিসেবে আমাকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। তার কারাগারে যাওয়ার বিষয়ে আমার হাত রয়েছে, এটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু না।
তিনি বলেন- আমার স্বামী কখনোই আওয়ামী লীগ করেনি। তিনি যুবদলের রাজনীতির সাথে যুক্ত। পাশাপাশি একটি পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। যা এলাকায় খোঁজ নিলে জানা যাবে।
এ বিষয়ে শাখাওয়াত হোসেন মনিরকে সংবাদ সম্মেলন করে পূর্ণিমা সরদারকে দায়ী করা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- যা বলার সংবাদ সম্মেলনে বলেছি, এখন কিছু বলতে পারবো না।
জানা গেছে- শাখাওয়াত হোসেন মনির সক্রিয় আওয়ামী লীগ কর্মী। বিগত ২০১২ সালে চরকাউয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্যাডে সভাপতি সুলতান আহমেদ খানের স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে শাখাওয়াত হোসেন মনির একজন সক্রিয় আওয়ামী লীগ কর্মী মর্মে প্রত্যয়ন দিয়েছিলেন। ৫ আগষ্টের পর নিজেকে রক্ষার্থে ভর করেন বরিশাল জেলা বাস্তুহারা দলের সভাপতি জসিম উদ্দিন মিলন ও সদর উপজেলা বাস্তুহারা দলের আহবায়ক শাহ আলম হাওলাদারের কাধে। এরপর থেকে মিছিল-মিটিং থেকে শুরু করে বাস্তুহারা দলের সব কার্যক্রম চলতো মনিরের দোকানে। এমনকি তাদের অর্থের যোগানদাতা হিসেবেও সুপরিচিতি লাভ করেন মনির।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে- ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর বরিশাল সদর উপজেলা বাস্তুহারা দলের ২৫ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সেসময় ওই কমিটির ৪ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন এইচ এম মঞ্জু নামের এক ব্যক্তি। তবে মনির গ্রেফতারের পর রাতারাতি এইচ এম মঞ্জুর নাম কেটে থেকে শাখাওয়াত হোসেন মনিরের নাম বসিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করানো হচ্ছে। এতে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাস্তুহারা দলের একাধিক নেতাকর্মী বলেন- ৫ আগষ্টের আগে মনিরকে বাস্তুহারা দলের কোন কার্যক্রমে দেখা যায়নি। সরকারের পতনের পর বাস্তুহারা কয়েকজন নেতার আশির্বাদে তিনি দলের পদ বাগিয়ে নিতে কয়েকটা মিটিংয়ে ছিলেন। তার দোকানে বসে সেই মিটিং করা হয়েছিল। তবে ত্যাগী নেতাদের চাপের মুখে ওই কমিটিতে তিনি স্থান পান নি। সম্প্রতি তাকে ওই কমিটির ৪ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক দেখানো হয়েছে। সেখানে ছিলো এইচ এম মঞ্জুর নাম। মনির দলের কয়েকজন নেতার সকল খরচ বহন করতেন বলে তারা জানান।
বরিশাল সদর উপজেলা বাস্তুহারা দলের সদস্য সচিব মোঃ সুমন হাওলাদার বলেন- ৫ আগষ্টের আগে শাখাওয়াত হোসেন মনিরকে বাস্তুহারা দলের কোন কার্যক্রমে দেখিনি। তবে ৫ আগষ্টের পরে তার নতুন বাজারের দোকানে বসে কয়েকটি মিটিং হয়েছে। তিনি যে আমাদের কমিটির যুগ্ম আহবায়ক তাও আমার জানা ছিলনা। আর আমি কমিটির সকলকে চিনিও না।
পূর্বে কমিটির প্যাডে ৪ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক এইচ এম মঞ্জু স্থানে কিভাবে শাখাওয়াত হোসেন মনিরের নাম আসলো সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- এ বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’
এ বিষয়ে সদর উপজেলা বাস্তুহারা দলের আহবায়ক শাহ আলম হাওলাদার বলেন- মনির আওয়ামী লীগ করেনি। সে বিএনপির সাথেই ছিল। আমি যতদূর জানি স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সভাপতি হয়েছেন মনির। এ নিয়ে স্থানীয় দুটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছে। আমরা মনে করি সেই বিরোধের সূত্র ধরে একটি মহল পুলিশকে ব্যবহার করে মনিরকে আওয়ামী লীগ আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।
৫ আগষ্টের আগে শাখাওয়াত হোসেন মনির বাস্তুহারা দলের কার্যক্রমে সক্রীয় ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন- হ্যা, সক্রীয় ছিল। তবে ব্যবসায়ীক কাজে ব্যস্ত ছিল বিধায় সকল কার্যক্রমে আসতে পারতো না।
এ বিষয়ে জানতে বরিশাল জেলা বাস্তুহারা দলের সভাপতি জসিম উদ্দিন মিলন বলেন- আমরা প্রথমে এইচ এম মঞ্জু নিয়ে কমিটি গঠন করি। পরে যেহেতু জানতে পারি এইচ এম মঞ্জু সরকারি চাকরি করে সেহেতু তাকে বাদ দিয়ে শাখাওয়াত হোসেন মনিরকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়।
একজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে দলের পদ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- মনির কখনোই আওয়ামী লীগ করেনি। সে আওয়ামী লীগের মামলায় কারাবরণও করেছে।
চরকাউয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্যাডে সভাপতি সুলতান আহমেদ খানের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- ওটা ভূয়া কাগজ। সুলতান আহমেদ খান এমন কোন কাগজ দেননি, উল্টো মনির আওয়ামী লীগ করে না এমন একটি কাগজ দিয়েছে।
সুলতান আহমেদ খান কাউকে প্রত্যয়ন দিয়ে আওয়ামী লীগ করে না এমন বিজ্ঞপ্তি দিতে পারে কিনা? এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি তিনি।
প্রসঙ্গত- গত বুধবার (১৬ এপ্রিল) রাজনৈতিক মামলায় বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের নয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগ কর্মী শাখাওয়াত হোসেন মনিরকে আটক করেছে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ। তাকে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান ফারুকের জি আর ৫৫৮ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
সরেজমিনে থানায় গিয়ে দেখা যায়- এসআই শফিকুল ইসলাম শাখাওয়াত হোসেন মনিরকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন। এ খবর শুনে থানায় ছুটে আসেন বরিশাল জেলা বাস্তুহারা দলের সভাপতি মিলন মুন্সি, বরিশাল সদর উপজেলা বাস্তুহারা দলের আহবায়ক শাহ আলম হাওলাদার, চরকাউয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারন সম্পাদক মাহমুদুর আশ্রাফসহ বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা। তারা হুঙ্কার দিয়ে বলতে থাকেন- শাখাওয়াত হোসেন মনিরকে কেন আটক করা হয়েছে? সে বিএনপির লোক। এ সময় তাদের কাছে শাখাওয়াত হোসেন মনির কিভাবে বিএনপির লোক হয়েছে, বিএনপির কোন মিছিল মিটিংএ তার ভূমিকা ছিল বা আছে কিনা জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান মিলন মুন্সি ও শাহ আলম হাওলাদার।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন- রাজনৈতিক মামলায় শাখাওয়াত হোসেন মনিরকে আটক করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি সাথে জড়িত বলে আমরা জানতে পেরেছি।