
নিউজ ডেস্ক :: অন্তর্বর্তী সরকারের করা ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রত্যাহার দাবিতে টানা চতুর্থ দিনের মতো সচিবালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দিয়েছেন, অধ্যাদেশটি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। খবর বিবিসি বাংলার।
গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদনের পর রোববার গেজেট আকারে জারি হয়। এর আগে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর থেকেই কর্মচারীরা এটি বাতিলের দাবিতে মিছিল সমাবেশ করে আসছে।
সরকারের দিক থেকে একজন উপদেষ্টা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেই বৈঠক হয়নি। সরকারও এই অধ্যাদেশ নিয়ে বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন সরকারি কর্মচারীদের দাবি পর্যালোচনা করে সুপারিশ করার জন্য এ সংক্রান্ত একটি কমিটি রোববারই পুনর্গঠন করা হয়েছে।
অধ্যাদেশে যা আছে
অধ্যাদেশটিতে চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতায় এনে তিনটি শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—বরখাস্ত, অব্যাহতি এবং বেতন ও পদের গ্রেড কমিয়ে দেওয়া।
যেসব অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া যাবে সেগুলো হলো— অনানুগত্য দেখানো ও কাজে বাধা দেওয়া, একক বা সমবেতভাবে কাজে অনুপস্থিত থাকা, কাউকে কাজ থেকে বিরত থাকতে উস্কানি দেওয়া এবং কাউকে কাজ করতে বাধা দেওয়া।
অধ্যাদেশের সরকারি কর্মচারীদের আচরণ ও দণ্ড সংক্রান্ত বিশেষ বিধান সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে- কোনো সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য কোনো কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কাজে বাধা তৈরি করে তাহলে সেটি হবে একটি অসদাচরণ।
এমন অপরাধের জন্য পদ বা বেতন গ্রেড অবনমিতকরণ, চাকরি থেকে অপসারণ এবং এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে।
আবার কেউ যদি একক বা দলবদ্ধভাবে ছুটি বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই কাজে অনুপস্থিত থাকেন বা এ ধরনের কাজ করতে কাউকে উস্কানি দেন বা কাউকে কাজ করতে বাধা দেন তাহলে তার জন্য একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বা এ বিষয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি অভিযোগ গঠন করে সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শাও নোটিশ দেবেন।
নোটিশের জবাব পেলে সেটি বিবেচনা করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে কিংবা তাকে কেন দণ্ড দেওয়া হবে না সেজন্য নোটিশ জারির সাত কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোও নোটিশ দেবেন কর্তৃপক্ষ।
এরপর অভিযুক্ত ব্যক্তি কারণ ব্যাখ্যা করে জবাব দিলে তা বিবেচনা করে বা জবাব না দিলে অধ্যাদেশে যেসব শাস্তির কথা বলা হয়েছে তার যে কোনো দণ্ড দেওয়া যাবে। কোনো কর্মচারীকে দণ্ড দেওয়া হলে তিনি ত্রিশ কার্যদিবসের মধ্যে আপিল করতে পারবেন।
তবে রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। যদিও দণ্ডপ্রাপ্ত কর্মচারী আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি যেভাবে মনে করবেন সেভাবে আদেশ দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে রিভিউ আদেশ চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
কর্মচারীদের আপত্তি কেন
সরকারি কর্মচারীরা আশঙ্কা করছেন, এ অধ্যাদেশের কারণে সরকারি কর্মচারীদের যে কোনো নিবর্তনমূলক সিদ্ধান্তও বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে হবে। পাশাপাশি তাদের মত প্রকাশের অধিকারও ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
কারণ কাজ বন্ধ করে সভা সমাবেশ কিংবা কর্মবিরতির মতো প্রতিবাদ কর্মসূচি তারা আর করতে পারবেন না, যেটিকে তারা তাদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার বলে তারা মনে করেন।
আবার এটি প্রয়োগ করে যে কাউকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার মাধ্যমে ভিন্নমতে বিশ্বাসীদের জন্য চাকরি করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে বলেও তারা অনেকে মনে করেন।
সচিবালয়ে বেলা আড়াইটার পর ঐক্য ফোরামের কো চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেছেন, এটি কার্যকর হলে কর্মচারীরা অফিসে বসদের অন্যায় আদেশও পালন করতে বাধ্য হবে। আবার সেটি না করলে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।
তিনি বলছেন, এই অধ্যাদেশ প্রয়োগ করবে কর্মকর্তারা আর এর শিকার হবে কর্মচারীরা। কর্মচারীরা অসদাচরণের ও অসম্মানমূলক আচরণের মুখোমুখি হবে। এই আইনটি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে তিনি জানিয়েছেন।
কর্মচারীদের আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের তরফে এখনো কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।
তবে গত রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, যে আইনটা হচ্ছে এটা ২০১৮ সালে সংশোধন হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার একটা সংশোধন করে ইলেকশনটা যাতে ম্যানিপুলেট করতে পারে, ওই রকম কিছু কিছু সংশোধন করেছিল। ওই সংশোধনটা শুধু বাদ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলছেন, আগে আইনটি যে রকম ছিল ওটাই করা হয়েছে। তারপরও যদি তাদের কোনো আপত্তি থাকে, তারা আলোচনা করতে পারে, কেবিনেট ডিভিশন কিংবা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। আলোচনা করে সমস্যাটা সমাধান করে নেবে।
কর্মচারীরা কী জবাবদিহিতার বাইরে থাকবে?
দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং তারা কেউ দুর্নীতি করলে তার শাস্তির বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছে।
দুর্নীতির বিষয়টি দেখার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন থাকলেও শৃঙ্খলা ভঙ্গ, অসদাচরণ কিংবা সংগঠনের ব্যানারে দলবদ্ধ হয়ে মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের যে প্রবণতা সেটি বন্ধ করার কার্যকর কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায়নি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা সবসময়ই নিজেদের অতি ক্ষমতায়িতভাবে এবং সেই কারণে নিজেরা যেটাকে যৌক্তিক মনে করে সেটাকেই নিজেদের মতো করে তারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। সরকারি কর্মচারীরা জানেন তাদের কোনো ধরনের আচরণ করা যাবে না। তাদের অযাাচিত অবস্থানের পাশাপাশি সরকারের কোনো উদ্যোগ না থাকায় অচলাবস্থার তৈরি হয় এবং তাতে করে জনভোগান্তি তৈরি হয়। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করছেন, এ অধ্যাদেশটি এখন প্রয়োজন ছিলো না। কারণ অধ্যাদেশে যেসব বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো অন্য বিদ্যমান আইনগুলোতে আছে।
তার মতে, কর্মচারীরা এখন বলপ্রয়োগ করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি সরকার কেন সবার সঙ্গে আলোচনা না করে তড়িঘরি করে এ ধরনের একটি অধ্যাদেশ করলো সেই জবাবটাও সরকারকে দিতে হবে।
আইনটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাবেক সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী যাই হোক-তারা অপরাধ বা দুর্নীতি করলে ব্যবস্থা নেয়ার সুনির্দিষ্ট আইন ও সংস্থা আছে। তাদের কাজ করতে কোনো বাধা নেই। শুধু কর্মচারীদের জন্য আলাদা করে কিছু করতে হবে কেন।
তিনি বলেন, একটা গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশের জন্য যেই পরিবর্তন আনার জন্য সবার কাজ করার কথা, সেখানে কর্মচারীদের ওপর খড়গহস্ত হওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা জনদুর্ভোগ, জনসেবায় বিঘ্ন কিংবা মানুষকে জিম্মি করতে যেন না পারে সেজন্য কঠোর কিন্তু যৌক্তিক আইন করতে হবে।
তিনি বলছেন, আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকতে হবে এবং নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে বেশিরভাগ কর্মচারী বিভিন্ন কর্মসূচিতে যায় তাদের নেতাদের ভয়ে কিংবা একঘরে হয়ে পড়ার ভয়ে। কারণ সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে সচিব-মন্ত্রীদের যোগসাজশ থাকে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, দাবি আদায়ের বিষয়ে কিছু বাজে নজির তৈরি হয়ে গেছে। কেউ অযাচিত পন্থা করলে সরকারের উচিত আলোচনা করে সেটার সমাধান করা যাতে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির স্বীকার না হতে হয়।
কী প্রেক্ষাপটে এমন অধ্যাদেশ
বাংলাদেশে ক্যাডার সার্ভিসগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত হলো অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন ও পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন। তাদের প্রায়শই সরকারের নানা সিদ্ধান্তে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়।
সমাবেশ করে নিজেদের দাবি দাওয়া প্রকাশ কিংবা সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করারও নজির আছে এই দুই সংগঠনের। বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মচারী বিভিন্ন দাবি নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন ও কলম বিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন গত কয়েক মাসে।
যদিও অধ্যাদেশের গেজেটে এটি জারির কারণ সম্পর্কে শুধু বলা হয়েছে, সংসদ না থাকায় এবং রাষ্ট্রপতির কাছে এমন অধ্যাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি এখন বিদ্যমান আছে।
সরকারের দিক থেকে আর কোনো ব্যাখ্যা না দেওয়া হলেও অনেকেই মনে করেন গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রশাসনযন্ত্র এবং সচিবালয়ের বিভিন্ন ঘটনার কারণেই সরকার এ ধরনের অধ্যাদেশের উদ্যোগ নিয়েছে।
বিশেষ করে পদ-পদোন্নতিসহ চাকরিসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ লেগেই আছে। গত মার্চে বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি ও রাস্তায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে ২৫টি ক্যাডারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ তখন দাবি করেছিলো যে, ফেসবুকে লেখালেখির কারণে ২৫টি ক্যাডারের ১৩ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।
এর আগে গত ডিসেম্বরে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশ ঘিরে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ও অন্যদিকে বাকি ২৫টি ক্যাডারের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছিলো।
এসব নিয়ে দফায় দফায় সংকট তৈরি হয়ে সরকারি কাজে অচলাবস্থার মতো পরিবেশও তৈরি হয়েছিলো গত কয়েক মাসে। এমনকি সচিবালয়ে সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের রুমে হাতাহাতি ও সচিবের রুমে তালা মেরে আন্দোলনসহ বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
আবার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী আর কর্মস্থলে আসেননি। তাদের বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নতুন অধ্যাদেশটি ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা আছে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।