ঢাকারবিবার , ১০ আগস্ট ২০২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পিরোজপুরের কচুরিপানা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ২৫ দেশে

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
আগস্ট ১০, ২০২৫ ৭:০০ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিউজ ডেস্ক :: কচুরিপানার ফুলকে অনেকেই পছন্দ করলেও অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা এর গাছ কচুরিপনাকে অনেকেই ফেলনা হিসেবে দেখেন। সময়ের ব্যবধানে এর ব্যবহার ও সহজলভ্যতার কারনে রপ্তানিযোগ্য পণ্য তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এটি। সেই ফেলনা কচুরিপানা এখন কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ২৫টি দেশে পিরোজপুরের উত্তরের উপজেলা নাজিরপুর।

এ উপজেলারই এক প্রত্যন্ত এলাকা গাওখালীর সোনাপুর গ্রাম। এখানকার নদী আর বিলে মাইলের পর মাইল দিগন্ত বিস্তৃত কচুরিপানা আপনার দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করলেও এই কচুরিপনাই এ এলাকার নিম্নবিত্তদের আয়ের এক অন্যতম উৎস। সকল বয়সের নারী পুরুষ এমনকি শিক্ষার্থীরাও তাদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে সহযোগী পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন এটি। সকাল হলেই ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন তারা কচুরিপানা সংগ্রহে। কিনতে খরচ না হলেও শুধু নামমাত্র খরচে সংগ্রহ করা হচ্ছে এগেুলো।

এলাকার শতকরা ৯৫টি পরিবার সংযুক্ত আছে এর সাথে। সংগ্রহকারীদের তালিকায় আছেন গৃহবধুরাও। বাদ জাননি শিক্ষার্থীরাও। মাঘ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত ভরা মৌসুম থাকলেও এর সংগ্রহ চলে সারা বছর জুড়ে। কাটার পর প্রসেস করে শুকাতে প্রায় ৫ থেকে ৬ দিন লেগে যায়। এর পরে বিক্রি।

প্রতি কেজি শুকনা কচুরিপনা বিক্রি হয় ৫০ টাকা দরে। ১ কেজি শুকনো মাল পেতে সংগ্রহ করতে হয় প্রায় আড়াই কেজি কচুরিপনা। মাসে প্রায় ১০ টন কচুরিপনা কেনা বেঁচা হয় এখানে। ফলে অনেকটা বিনা পুঁজিতে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এলাকার মানুষ। দৃষ্টি নন্দন ফুলঝুড়ি, কালারফুল পাপোশ, রকমারী ফুলদানী আর পাটি তৈরির কাচামাল এ কচুরিপনা। ব্যাগ, টুপি আর সুন্দর সব জায়নামাজও তৈরি হয় এর থেকে। ফলে বিদেশে এর চাহিদা অনেক। এ গ্রামের প্রায় ৩ শতাধিক পরিবারের কর্মসংস্থান হচ্ছে এ কচুরিপনা থেকে ।

আর কাঁচামাল হিসেবে বিশ্বের ২৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে এটি। এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষ এ পেশায় বেশি জড়িত। এলাকার মা-বোন ও বেকার যুবকরা এই কাজে নিয়োজিত রয়েছে। কচুরিপানা হাতের নাগালে পাওয়ার কারণে অবসর সময় এই কাজে হাত লাগাচ্ছে এলাকার বেকার যুবকরাও। এই কচুরিপানা কেটে যা উপার্জন হয়, তা থেকে অনেক পরিবারের সংসার চলে। এই কাজে অর্থ উপার্জন করে অনেকেই গবাদি পশু সহ হাঁস মুরগি ক্রয় করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে ‌।

প্রায় ৩৬০ পিছ কচুরিপানায় এক কেজি পরিমাণ হয়ে থাকে। প্রতি কেজি কচুরিপানা ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। এই ব্যবসা করে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। কেননা এই ব্যবসার জন্য কোন মূলধন প্রয়োজন হয় ‌না। প্রাকৃতিক কচুরিপানা থেকে তৈরি করা কাঁচামাল দেশের উত্তর অঞ্চলের রংপুর সহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলের কুটিরশিল্পে পাঠানো হয়। যেখান তৈরি হয় রঙিন পাটি, হাত ব্যাগ, ফুলদানি, টুপি, জায়নামাজ সহ বিভিন্ন হস্তশিল্প সামগ্রী। এগুলো রপ্তানি হয় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, জাপান সহ বিশ্বের ২৫ টি দেশে। উদ্যোক্তা আলমগীর হোসেন বলেন, এই কচুরিপানা হাতের নাগালেই পাওয়া যায়।

৫০ টাকা কেজিতে কচুরিপানা বিক্রি হয়। ১ কেজি ধানের দাম ১ হাজার টাকারও বেশি। এক মন কচুরিপানা বিক্রি করে দুই মন ধান ক্রয় করা যায়। দুই মন ধান উৎপাদন করতে অনেক খরচ হয় ‌। সেখানে কচুরিপানা উৎপাদনে কোন খরচে নেই প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন হয়। কচুরিপানা কেটে রোদে শুকিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসলেই প্রতি কেজিতে ৫০ টাকা করে দেই। কচুরিপানা বিক্রির জন্য যে কোয়ালিটি গুলো থাকা দরকার। প্রতিপিস কচুরিপানা সর্বনিম্ন ১৮ ইঞ্চি হতে হবে।

রোদে শুকিয়ে সাদা করতে হবে। একদম শুকনো হতে হবে, কোন রস থাকবে না। এরকম কচুরিপানা আমার কাছে নিয়ে আসলে ৫০ টাকা কেজি ধরে আমি কিনে রাখবো। সরকার যদি আমাদের প্রতি একটু দৃষ্টি রাখে, তাহলে এই এলাকার যদি একটু উন্নয়ন হয়, রাস্তাঘাট যদি ভালো হয় তাহলে এই পেশায় কর্মসংস্থান আরো বৃদ্ধি পাবে। এই কচুরিপানা বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানি কিনে থাকে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করে।

এমনকি বাংলাদেশ থেকে এই কচুরিপানা বিশ্বের অনেক দেশে রপ্তানি হয়। স্থানীয় যুবক শাহীন বলেন, বর্তমানে কাজকাম কম এ কারণে এই কাজ করছি। কচুরিপানা কেটে রোদে শুকিয়ে বিক্রি করি। প্রতি কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি করি‌। এ থেকে আমরা খুব ভালো টাকা ইনকাম করতে পারি।

অবসর সময় আমরা এই কাজটা বেশি করে থাকি। শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম বলেন, কচুরিপানা আমাদের কোন কাজে লাগে না। এগুলো যেখানে উৎপাদন হয় সেখানেই আবার নষ্ট হয়ে যায় ‌। আমি একজন শিক্ষার্থী কিন্তু আমার কোন ইনকাম নাই। অবসর সময়ে আমি কচুরিপানা কাটি এবং রোদে শুকিয়ে বিক্রি করছি। এর আগে আমাকে একটা পোশাক কিনতে হলে বাবা-মার কাছ থেকে টাকা নিতে হতো কিন্তু বর্তমানে আমি নিজে টাকা ইনকাম করে ভালো পোশাক কিনে কলেজে যাচ্ছি। আমার কাছে অনেক ভালো লাগছে ‌। এখন বাড়ি থেকে টাকা নেয়া লাগেনা, আমি নিজের টাকায় নিজে চলতে পারছি। স্থানীয় বাসিন্দা কায়সার আহমেদ বলেন, এখানে ইনকাম করার আলাদা কোনো পথ নেই। কৃষির অবস্থাও ভালো না।

দিন দিন সার ওষুধ ও কীটনাশকের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ দিনে দিনে অসচ্ছল হয়ে পড়ছে। এখানকার মানুষ কচুরিপানা কেটে রোদে শুকিয়ে বিক্রি করে আর্থিক উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে। এটা করতে কোন মূলধনের প্রয়োজন হয় না। স্থানীয় বাসিন্দা উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাইসুল ইসলাম বলেন, এই এলাকার অনেক মানুষ বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ এনে পরিবারের কাজে খরচ করেছে কিন্তু ঋণ পরিষদের তেমন কোন কর্মসংস্থান তাদের নেই।

বর্তমানে কচুরিপানা কেটে রোদে শুকিয়ে বিক্রির মাধ্যমে তারা ঋণ পরিশোধ করছে এবং তাদের ভিতরে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসতে শুরু করেছে। কচুরিপানা বিক্রেতা ও বয়স্ক নারীকর্মী সুফিয়া বেগম বলেন, এখানে আমি যে কচুরিপানা শুকিয়ে বিক্রির জন্য এনেছি তার মূল্য হয়েছে ১১৯০ টাকা। আকাশ মেঘলা থাকার কারণে শুকাতে দু-তিন দিন বেশি সময় লেগেছে। প্রতিমাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার কচুরিপানায় বিক্রি করি। এই টাকাটা সংসারের প্রয়োজনে খরচ করি।

এনজিওর কিস্তি দেই। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, শুনেছি নাজিরপুর উপজেলার গাওখালী এলাকার কচুরিপানা বিদেশে যাচ্ছে। বিষয়টি খুবই ইতিবাচক । এগুলো চাষ করে নয় বরং প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কচুরিপানা ‌।

আমরা খতিয়ে দেখছি কিভাবে এই উদ্যোগে কৃষকদের সহায়তা করা যায়। অনুন্নত রাস্তাঘাট এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে কুটির শিল্পের এই কাঁচামাল তৈরি করতে গিয়ে প্রায়ই নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই পেশার সংশ্লিষ্টদের দাবি এই এলাকার রাস্তাঘাট উন্নতকরণ এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হলে কাঁচামালের গুণগতমান বৃদ্ধি পাবে।