
নিউজ ডেস্ক :: রংপুরের তারাগঞ্জে ভ্যানচোর সন্দেহে এলাকাবাসীর পিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন শ্বশুর রূপলাল দাস (৫৫) ও জামাই প্রদীপ লাল (৩৮)। মৃত্যুর আগে তারা দুহাত জোড় করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন খুনিদের কাছে। রূপলাল বারবার বলেছিলেন, ‘আমি চোর না, ডাকাত না।’ তবুও ক্ষুব্ধ ‘জনতা’র হাত থেকে রক্ষা পাননি তারা। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তাদের হাতজোড় করে অনুনয়ের একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বটতলা এলাকায় গত শনিবার চোর সন্দেহে পিটুনিতে নিহত দুজন হলেন তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রূপলাল দাস ও তার আত্মীয় মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের বাসিন্দা প্রদীপ লাল। এ নিয়ে চলতি বছরে মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে কমপক্ষে ১১১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। চোর সন্দেহে এই দুই হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল সোমবার আসকের সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই উদ্বেগের কথা জানানো হয়।
এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সামাজিক সম্প্রীতি ও আইনের শাসনের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে আসকের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এ ধরনের ঘটনা প্রচলিত আইন, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অগ্রহণযোগ্য।’
রূপলাল ও প্রদীপ লালকে পিটুনির সময়কার ভিডিওতে দেখা যায়, স্থানীয় কয়েকজন রূপলাল ও প্রদীপকে ভ্যানসহ আটক করেন। তাদের ভ্যান থেকে একটি প্লাস্টিকের বস্তা বের করে নাম-পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। একপর্যায়ে উত্তেজিত কয়েকজন তাদের মারতে উদ্যত হলে মেহেদী হাসান নামের এক যুবক বাধা দেন এবং পুলিশে খবর দেওয়ার কথা বলেন। তখন রূপলাল বলেন, ‘আমি চোর না, ডাকাতও না। মুচি, তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করি।’ তবে উপস্থিত এক ব্যক্তি উচ্চ স্বরে বলেন, ‘তুই চোর-ডাকাইতের বাপ।’
এরপর রূপলাল প্রস্রাব করতে চাইলে উত্তেজিত লোকজন ভেবে বসে তিনি পালাবেন, তাই তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ পর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন ভ্যানের ওপরে বসে ছিলেন প্রদীপ লাল। সেখানে থাকা লোকজন বলে, ‘মাল খেয়ে আসছে, অভিনয় করছে।’
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে প্লাস্টিকের বোতল বের করে নাকের কাছে নেন এক যুবক। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, ‘এ ভাই, দয়া করি আমাকে ধরো’ বলেই মাটিতে পড়ে যেতে থাকেন। এরপর দুজন তাকে কোলে করে সরিয়ে নেন; কিন্তু উপস্থিত লোকজন আবারও রূপলাল ও প্রদীপকে মারধর শুরু করেন।
রূপলাল ও প্রদীপকে উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপ লালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ভোর ৪টায় তার মৃত্যু হয়।
পুলিশ ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল থেকে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রূপলালের লাশ বাড়িতে পৌঁছলে এলাকাবাসী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে ৭০০ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। পুলিশ ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলো—তারাগঞ্জের সয়ার ইউনিয়নের বালাপুরের এবাদত হোসেন (২৭), বুড়িরহাটের আক্তারুল ইসলাম (৪৫), রফিকুল ইসলাম (৩৩) ও রহিমাপুরের মিজানুর রহমান (২২)।
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক কালবেলাকে বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজে বিশ্লেষণ এবং স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউই রেহাই পাবেন না।’