
নিজস্ব প্রতিবেদক :: ঝালকাঠির বাসন্ডা সেতুতে হাজার জোড়াতালি : ৩-৪ গুণ বেশি ওজন বহনে বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা।
একটার পর একটা পাইতরা বুনে যেমন পাটি তৈরি হয়, তেমনি ঝালকাঠির বাসন্ডা সেতুর পাটাতনে বছরজুড়ে বসানো হয়েছে লোহার পাত, দেওয়া হয়েছে জোড়াতালি। ১২০ মিটার দৈর্ঘ্যের বেইলি সেতুটির পাটাতনে এখন হাজারের বেশি জোড়াতালি। পুরো কাঠামো যেন লোহার সেলাইুকাটা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক জরাজীর্ণ লৌহপাটি।
এদিকে, সংস্কার চললেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন নেই।
সামান্য ওজনের যানবাহন উঠলেই সেতু কাঁপে, নিচের নদীর পানি কাঁপে, আশপাশের মানুষের বুক কেঁপে ওঠে—কাঁপে না শুধু সড়ক বিভাগ। বছরের পর বছর এই সেতুর মেরামতে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা, যে অর্থে নতুন সেতু নির্মাণ করা যেত। তাই অতি ঝুঁকিপূর্ণ এই সেতুটি অপসারণ বা পুনর্নির্মাণে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে বিপদ মাথায় নিয়েই বরিশাল-খুলনা মহাসড়কে যান চলাচল করছে।
ঝালকাঠি শহরের চাঁদকাঠী এলাকায় গত শতাব্দির আশির দশকে নির্মিত এই সেতু বহু আগেই অস্থায়ী কাঠামো হিসেবে কার্যক্ষমতার সময়সীমা পার করেছে। এখন প্রতিদিন কয়েক হাজার যানবাহন ছুটে চলে এর ওপর দিয়ে। পদ্মা ও বেকুটিয়া সেতু চালুর পর ওই চাপ আরো বেড়েছে। অথচ সেতুটি ধারণ করতে পারে মাত্র সাত টন।
নিয়ম অমান্য করে প্রতিদিনই তিন-চার গুণ বেশি ওজনের বাস-ট্রাক চলাচল করে। প্রতিবার গাড়ি উঠলে সেতু দুলে ওঠে। স্থানীয়দের ভাষায়, ‘এটা সেতু নয়, লোহার দুলুনি।’
তীব্র শব্দে পাটাতনের প্লেট কেঁপে ওঠে যেন ভেঙে পড়ার আগাম সংকেত দিচ্ছে প্রতিটি জোড়াতালি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিবছর মেরামতের নামে শুধু জোড়াতালির সংখ্যা বেড়েছে।
একটি লোহার পাত বদলানোর পর কয়েক মাস যেতেই আবার নতুন জোড়াতালি দিতে হয়। যেন জোড়াতালিই সেতুর স্থায়ী চিকিৎসা।
৯ বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ
১৯৮৯ সালে নির্মিত বাসন্ডা বেইলি সেতুর দৈর্ঘ্য ৩৯৪ ফুট, প্রস্থ ২৫ ফুট। নির্মাণকালে এটি সাত টন ভার বহনের সক্ষমতায় নির্মিত হলেও বাস্তবে প্রতিদিনই এর ওপর দিয়ে তিন-চার গুণ বেশি ওজনের যান চলে। সেতুর পাটাতনে এখন ছয় শতাধিক জোড়াতালি। ২০১৬ সালে সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে প্রতিবছর মেরামতে গড়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। গত ৯ বছরে পাটাতন বদলানো ও ঝালাই মেরামতে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা, যা দিয়ে নতুন সেতু নির্মাণ করা যেত।
ঝালকাঠি সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহারিয়ার শরীফ খান বলেন, ‘নতুন কংক্রিট সেতুর জন্য নকশা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই নির্মাণকাজ শুরু হবে।
সেতুর নিচে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস
বাসন্ডা সেতুর নিচে থাকেন হাবিব শিকদার। নির্মাণকালে তিনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। সেই সময় থেকেই সেতুর নিচেই তাঁর বাস। হাবিব বলেন, শুরুতে সেতুর নিচে বড় লোহার প্লেট ছিল। কয়েক বছরের মধ্যেই প্লেটগুলোতে মরিচা ধরে নাটুবোল্ট ক্ষয়ে যায়। পরে ছোট আকারের প্লেট বসানো হয়। এখন সেখানে অন্তত ২৮৫টি প্লেট রয়েছে। প্রতিটির সঙ্গেই অসংখ্য জোড়াতালি। গাড়ি উঠলেই তীব্র শব্দে আশপাশ কেঁপে ওঠে।
হাবিব জানান, একবার নড়বড়ে পাটাতন ভেঙে একটি গাড়ি নিচে পড়ে যায়। স্থানীয় এক দরবেশের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েও পাটাতন ভেঙে নিচের চায়ের দোকানে পড়ে আহত হন। হাসপাতালের পথেই মৃত্যু হয় তাঁর।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে সেতুর নিচের মসজিদের ওজুখানায় পানি তুলছিলেন হাবিবের মেয়ে কলি বেগম। তিনি জানান, সেতুর নিচে তাঁদের হোটেল ছিল প্রায় ৩০ বছর ধরে। তাঁর বাবা হোটেল চালাতেন, তিনি সহযোগিতা করতেন। কিন্তু সেতুর নড়বড়ে অবস্থা ও তীব্র শব্দে এখন আর ক্রেতা আসে না। তাই সেতুর নিচের ঘরে শুধু রান্না করা হয়। পাশের একটি দোকান ভাড়া নিয়ে সেখানে খাবার পরিবেশন করা হয়। রাতে সেতুর নিচের ঘরেই থাকেন। ভয় করে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভয় তো আছে, কিন্তু ভাড়া লাগে না—তাই ঝুঁকি নিয়েই থাকতে হয়।’
সেতুর নিচেই বায়তুল রোদোয়ান জামাতে মসজিদ। প্রায় ১৯ বছর ধরে এখানে ইমামতি করছেন মাওলানা আবুল বাশার। তিনি বলেন, আগে এত শব্দ হতো না। প্রায় এক দশক ধরে শব্দ এত বেড়েছে যে নামাজ পড়াতে সমস্যা হয়। তাই সব সময় সাউন্ডবক্স ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু নামাজের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে পেছনের মুসল্লিরা ইমামের কথা শুনতে পান না—তখন ইশারায় নামাজ আদায় করতে হয়।
মাওলানা বাশার আরো বলেন, নির্মাণের সময় মসজিদটি কিছুটা বাঁকা হয়ে যায়। তা ঠিক করার জন্য অর্থ জোগাড় হয়েছে। কিন্তু সেতুর সংস্কার কাজ শুরু না হওয়ায় নতুন মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ এগোচ্ছে না।


