ঢাকামঙ্গলবার , ৫ আগস্ট ২০২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই ঢাকামুখী জ*ন*স্রো*ত, স্বৈ*রা*চা*র হাসিনার প*লা*য়*ন

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
আগস্ট ৫, ২০২৫ ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিউজ ডেস্ক :: মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনসম্পৃক্ত আন্দোলনটি সংঘটিত হয় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে। নজিরবিহীন দমন-পীড়নের কারণে কোটা সংস্কারের দাবি রূপ নিয়েছিল এক দফার আন্দোলনে। সেটি ছিল ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ’। গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পালাবদলের ঘটনা।আওয়ামী লীগের পতন পর্বের শুরুটা হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর সমালোচনা এবং প্রধান বিরোধী দলগুলোর বয়কটের পরও বিতর্কিত নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ৭ জানুয়ারি, ২০২৪ সালে। একতরফা এ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। যদিও জাতীয় পার্টি ও কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলেন।

দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে প্রায় সব বিরোধী দল ও মতকে কোণঠাসা করতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনা। শুধু তা-ই নয়, পরপর প্রশ্নবিদ্ধ তিনটি নির্বাচন করেও তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন। ফলে জনমনে এমন একটি ধারণা বা ‘মিথ’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল যে, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে কিছুতেই ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না। ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণই যে নিয়ামক শক্তি, এ কথা দেশের মানুষ প্রায় অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। জনগণের পাশাপাশি এক যুগ ধরে আন্দোলন ও মামলা-হামলার মুখে থাকা বিএনপির একাংশের মধ্যেও এমন ধারণা বা বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছিল। কারণ, একবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং দুবার নির্বাচন বর্জনের পরও কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছিল দলটির মধ্যে।

২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব বন্দির মুক্তি দাবি

২৪ ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলন ঘিরে গ্রেপ্তার হওয়া সব বন্দির মুক্তির দাবি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে ডেকে তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করব। সেই জাতীয় সরকারে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-নাগরিকদের অংশ থাকবে এবং নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও বিভিন্ন পক্ষ থাকবে। সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের রূপরেখা এবং সেই সরকারে কারা কারা থাকবেন তাদের নাম ঘোষণা করব।

রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন জানিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিকেলে বলেন, এখন রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। সব হত্যার বিচার হবে। সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখেন। আমরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।

জনগণের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বলেন, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখেন। আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখেন, একসাথে কাজ করি। দয়া করে সাহায্য করেন। মারামারি, সংঘাত করে আর কিছু পাব না। সংঘাত থেকে বিরত হোন। সবাই মিলে সুন্দর দেশ গড়ি।

ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাব। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে ওনার সঙ্গে কথা বলব। তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করা হবে।

সব হত্যা ও অন্যায়ের বিচার হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আপনারা সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখেন। আমরা সমস্ত দায়দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনাদের কথা দিচ্ছি, আশাহত হবেন না। যত দাবি আছে, সেগুলো আমরা পূরণ করব। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসব। আমাদের সহযোগিতা করেন। প্রতিটি হত্যার বিচার হবে।

ভাঙচুর, হত্যা, সংঘর্ষ ও মারামারি থেকে জনগণকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আসুন, একসঙ্গে কাজ করি। নিঃসন্দেহে সুন্দর পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে পারব। মারামারি ও সংঘাত করে আর কিছু পাব না। তাই দয়া করে ধ্বংসযজ্ঞ, অরাজকতা ও সংঘর্ষ থেকে বিরত হন। সবাই মিলে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে আমরা অগ্রসর হব।’

গণভবনে ঢুকে পড়েন অসংখ্য মানুষ

শেখ হাসিনার পতন হয়েছে— এমন খবরে গণভবনে ঢুকে পড়েন অসংখ্য মানুষ। তারা গণভবনের মাঠে উল্লাস প্রকাশ করেন। এ সময় অনেকের হাতে গণভবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস দেখা যায়।

মোবাইল ইন্টারনেট চালু

একদিন বন্ধ থাকার পর দুপুর ২টার পর মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। এর আগের দিন সকালে কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পুনরায় চালু হয়।

সংখ্যালঘুদের রক্ষায় গ্রামেগঞ্জে শিক্ষার্থীদের দাঁড়ানোর আহ্বান

গ্রামেগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় সংখ্যালঘুদের রক্ষায় শিক্ষার্থীদের দাঁড়ানোর আহ্বান জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। ৫ আগস্ট রাতে এক ব্রিফিংয়ে হান্নান মাসউদ বলেন, আমি এ দেশের ছাত্র-জনতাকে বলব প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় আমাদের সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের রক্ষার্থে সকলে দাঁড়িয়ে যান, যাতে কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে।

দানবের হাত থেকে জাতি মুক্তি পেল : ফখরুল

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে দানবের হাত থেকে জাতি মুক্তি পেয়েছে।’ বঙ্গভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, অবিলম্বে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে গত কিছুদিনে যত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছে তাদেরও মুক্তি দিতে হবে।

ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনা-বাড়ি রক্ষায় শিবিরের আহ্বান

ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর দেশবাসীকে শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানায় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। ৫ আগস্ট এক যৌথ বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম বলেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষা; সর্বোপরি একটি সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিবৃতিতে নেতারা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আপামর সচেতন নাগরিকদের প্রতি কিছু আহ্বান ব্যক্ত করেন– স্বৈরাচার থেকে মুক্ত করার জন্য সালাতের মাধ্যমে সবাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। দেশে দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনতে সবাই সহযোগিতা করুন। যারা জুলুমকারী আছে, তাদের শাস্তি দেশের মাটিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সব সরকারি সম্পদের মালিক জনগণ। তাই কোনো সরকারি সম্পত্তি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেগুলো সুরক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেকেরই নিতে হবে। দেশের সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে চমৎকার সম্প্রীতি রয়েছে তা যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয় সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

রাতে ইসলামী আন্দোলনের আমির এক বিবৃতিতে বলেন, জালিম ও দুর্নীতিগ্রস্ত এক নৃশংস স্বৈরশাসকের কবল থেকে জনগণ মুক্তি পেয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। এখন সময় দেশ গড়ার, নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের। সাম্য, সামাজিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমৃদ্ধ রাষ্ট্র নির্মাণের সংগ্রামে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও তিন বাহিনীর প্রধানদের বৈঠক

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সভাপতিত্বে সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্যে সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান ও বিমান বাহিনীর প্রধান এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে কোটাবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়।

রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানান, বৈঠকে অনতিবিলম্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সভায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবাইকে ধৈর্য ও সহনশীল আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়। সেনাবাহিনীকে লুটতরাজ ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অনতিবিলম্বে মুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সম্প্রতি বিভিন্ন মামলায় আটক সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি যেন কোনোভাবেই বিনষ্ট না হয় সে ব্যাপারেও সভায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাস, জামায়াতে ইসলামের আমির ড. শফিকুর রহমান ও শেখ মো. মাসুদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, হেফাজতে ইসলামের মামুনুল হক, মুফতি মনির কাসেমী ও মাহাবুবুর রহমান, মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে রাব্বি, জাকের পার্টির শামিম হায়দার, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা জালাল উদ্দীন আহমদ, গণসংহতি আন্দোলনের জুনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের অ্যাডভোকেট গোলাম সারওয়ার জুয়েল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, ফিরোজ আহমদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ আল হোসাইন, আরিফ তালুকদার, ওমর ফারুক ও মোবাশ্বেরা করিম মিমি এবং ইঞ্জিনিয়ার মো. আনিছুর রহমান।