ঢাকামঙ্গলবার , ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

বরিশালে মাদকের ৪টি হটস্পট : নেশার জন্য গতমাসে তিন দিনে খুন ২ জন

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫ ১:৫৪ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশালে মাদকের ৪টি হটস্পট : নেশার জন্য গতমাসে তিন দিনে খুন ২ জন।

 

বরিশালে যারা মাদকের হোল সেলার তারা শত শত পেটি মাদক বেঁচাকেনা করছে। পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা সবাই তা জানে। সে অনুযায়ি পুলিশ অভিযান চালিয়ে এসব মাদকের গডফাদারদের গ্রেপ্তারও করছে কিন্তু ধরে রাখতে পারে না। উচ্চ আদালত থেকে গ্রেপ্তার হওয়া গডফাদাররা জামিন নিয়ে বের হয়ে আবার তাদের ব্যাবসাটাই করছে। মাদকের বিস্তার কমছে না। কারন হলো-আইনে বলা আছে ‘মাদক অপরাধিদের আটকাতে হলে তাদের কাছ থেকে মাদক উদ্ধার দেখাতে হবে। অথচ মাদক গডফাদাররা তাদের সাথে একটা বিড়িও রাখে না।
পুলিশের সাম্প্রতিক তথ্য এমন কথাই বলছে। তথ্যে আরো বলা হয়ছে- বরিশালে ৪টি হটস্পট থেকে কয়েকশ ভ্রাম্যমান বাহকের মাধ্যমে মাদকের প্রকাশ্যে বেঁচাকেনা ও ব্যবহার ভয়াবহভাবে বেড়েছে। গত মাসে ৩ দিনে নেশার টাকার জন্য দু’জন খুন হয়েছে। অভিভাবকদের দেখা মিলছে নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে। পুলিশ বলছে মাদকের গডফাদারদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। এজন্য আইনের সংশোধন দরকার।

গত ২৯ জুলাই বাকেরগঞ্জে মাদকাসক্ত সন্তানকে নেশার টাকা না দেয়ায় হামলা ভাংচুর করায় হাসান গাজি নামে নিজ সন্তানকে হত্যা করে থানায় আত্মসমর্পন করে এক দম্পতি। এর দুদিন আগে ২৭ জুলাই উজিরপুর উপজেলার বরাকোঠা গ্রামে নেশার টাকা না পেয়ে শিমুল খান নামে এক যুবক তারা বাবার গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছে। এসব ঘটনা বরিশালের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ভীতির সৃষ্টি করেছে। এর পরেও মাদকের বানিজ্য থেমে নেই। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর বলছে নেশার তাড়নায় খুন করার প্রবনতা বেড়েছে। বরিশালের আগামিটা আরো ভয়াবহ হতে পারে।

মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর এর অতিরিক্ত পরিচালক পরিতোষ কুমার কুন্ড বলেন, মাদক না পেলে মাদকসেবী যে কোন কিছু করতে পারে। মা-বাবাকে খুন কোন বিষয়ই না। এখন ব্যবহৃত সিন্থেটিক ড্রাগস ইয়াবা, আইস, ফেন্সিডিল, হিরোইন মস্তিস্ককে ভয়াবহভাবে এতোটা ড্যামেজ করে দেয় যে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সুতরাং এসব মাদকাসক্তের জন্য যাকে তাকে খুন করা কোন ব্যাপারই না। আমরা নিয়ন্ত্রন করছি কিন্তু যেভাবে লেটেস্ট ড্রাগস আসছে তাতে আগামি চলমান কৌশলে নিয়ন্ত্রন করা যাবে না। বরিশালে বর্তমানে মাসে ১০ হাজার লিটার দেশি মদ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু নেশা ভালো হওয়ায় এখানকার মানুষ ইয়াবা খাচ্ছে বেশি। গত বছরের জুন মাসের চেয়ে এবার জুনে দ্বিগুন মামলা হয়েছে, এটা লাল সংকেত দিচ্ছে।

ভুক্তভোগী পরিবার ও নিরাময় সংশ্লিষ্টদের মতে মহানগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে মাদকের প্রাপ্তি সহজ ও সুলভ হওয়ায় কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের মধ্যে নেশা করার প্রবনতা বেড়েছে। বরিশালের ৭টি নিরাময় কেন্দ্রের ২০০ আসনে এখন মাদকাসক্ত রয়েছেন ৪২৩ জন। অভিভাবকদের সার্বক্ষনিক সন্তানের জন্য এখানে প্রতীক্ষায় দেখা যায়। এরা পরিত্রাণ চেয়েছেন পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে। উদ্যোক্তারা জানান, রোগী সামাল দেয়া তাদের জন্য এখন কষ্ট হচ্ছে। তারা নিজেরাও মাদকের এমন পরিস্থিতিতে শংকা প্রকাশ করেছেন।
এক মা কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলেন, মাদক সেবনের পর আমার সন্তান যে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ঐ সময় সে একশ মানুষকেও খুন করতে পারে। তখন মা হয়ে আমি স্থির থাকতে পারি না। আমি রাস্তায় রাস্তায় ওর পিছু দৌঁড়াই, আমিতো ওর সাথে শক্তিতে পারি না। অনেক কষ্ট করছি। নিরাময় কেন্দ্রে দিয়ে আজ খুশি। যে সন্তান আমাকে এতো সম্মান করতো সে আমাকে লাথি মারতে আসে। সন্তানের এই অবস্থা দেখে আমি নিজেই আত্মহত্যার চেষ্টা করতাম।

অন্য এক বোন বলেন, আমার আজ ভাই লাশ, মা-বাবা জেলে। এর সব কিছুই নেশার কারনে হয়েছে। আমি চাই প্রত্যেক বাবা-মা তার সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখুক, তারা যেন নেশাগ্রস্ত না হয়। নেশা জাতীয় দ্রব্য বিক্রি কে করছে তা যেন প্রশাসন তদন্ত করে। আজ আমার ভাই গেছে কাল কিন্তু অন্য একজন যাবে।
অপর এক অভিভাবক বলেন, আমাদের সন্তান আজ রি-হ্যাবে থাকে, এটা খুবই কষ্টের। মাদক উদ্ধারের নামে যে নাটকীয় অভিযান চালায় ওরা এটা বুঝবে না। ওদের সন্তানরা এখানে থাকলে বুঝতো। ওরা গডফাদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় না। মাদক এখন আমার সন্তানের হাতের মুঠোয়, এটা সহজলভ্য হওয়ায় সন্তানরা মাদকাসক্ত হচ্ছে।
বরিশালের স্বনামধন্য মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র নিউ লাইফ এর পরিচালক মর্তুজা জুয়েল বলেন-গত ১৫ বছর ধরে আমরা মাদক নিরাময়ে কাজ করছি। এমন ভয়াবহতা কখনো দেখিনি। ইদানিং নিরাময় কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে বাড়িতে ফিরে আবার আসক্ত হয়ে এখানে আসছে। কাউন্সেলিং এ ওরা মাদকের সহজলভ্যতার কথা বলেছে। আসক্তদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ, ছাত্র-ছাত্রী। সাম্প্রতিক সময় মেয়েরাও মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। আমার এখানে ১২ জন নারী ও শতাধিক পুরুষ মাদকাসক্ত রয়েছে। গ্রমগঞ্জে সর্বত্র এখন মাদকে সয়লাব।

গত এক বছরে বরিশাল জেলা ও মেট্রোপলিটান পুলিশ মাদকসহ গ্রেপ্তার করেছে ১০২২ জনকে। এসময় ১৯টি ক্রিস্টাল আইস, ৫০ হাজার পিস ইয়াবা, ৩১২ কেজি গাঁজা, ১৬৭৮ বোতল ফেন্সিডিলসহ অনেক সামগ্রি উদ্ধার করা হয়।
বরিশালের পুলিশ সুপার শরিফ উদ্দীন বলেন-যারা মাদক গ্রহণ করে এবং প্রান্তিক পর্যায়ে বিক্রি করে তাদের আমরা ধরতে পারছি, কিন্তু রুট লেভেলে যাওয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রন সত্যিই কঠিন। সামাজিক অবক্ষয় আর পারিবারিক শিক্ষা না থাকায় মাদকাসক্ত বেড়েছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। মাদক উদ্ধার হচ্ছে, সেবীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। কিন্তু মাদকতো এখন ছড়িয়ে গেছে। ভ্রাম্যমানভাবে বিক্রি হচ্ছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন প্রতি পরিবারকে সচেতন হতে হবে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ মাদক ব্যবসার ৪টি হটস্পট চিহ্নিত করেছে। এখান থেকেই কয়েক‘শ ভ্রাম্যমান বাহকের মাধ্যমে মহানগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মাদক ছড়িয়ে পড়ছে। একাজে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশুদের।

বিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন-বরিশালের মাদকের হটস্পট আছে ৪টি। কেডিসি, রসুলপুর ও পলাশপুর বস্তি এবং কাশিপুর এলাকা। এখান থেকে কয়েকশ ভ্রাম্যমান বিক্রেতার মাধ্যমে এটা গ্রাম পর্যায়ে যাচ্ছে। আমাদের অভিযানের অগ্রগতি দিয়ে মাদক পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না। বড় মাদক ব্যবসায়িদের ধরে রাখা যাচ্ছে না, ওরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে আবার একই ব্যবসা করছে। মাদকের বড় চালান যারা আনছে তারা বিক্রি করছে না। তাদের কাছে মাদক পাওয়াও যাচ্ছে না। তাই আইন অনুযায়ি ওদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া যাচ্ছে না। এজন্য আমি মনে করি কিছুটা হলেও মাদকের প্রচলিত আইনের সংশোধন হওয়া দরকার। ওরা এখন মাদক বহনের কাজে ছোট ছোট শিশুদের ব্যবহার করছে। এই শিশুগুলোকে ধরেও আমরা আইনের আওতায় নিতে পারছি না।
উল্লেখ্য গত একবছরে বরিশাল জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের ১৪টি থানায় ৭৯৯টি মাদক মামলা হলেও আসামিরা জামিন নিয়ে বাইরে এসে একই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।