ঢাকাবুধবার , ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ওরে তুষার অকালেই চলে গেলি, ভুলি কি করে সেই অম্লান স্মৃতি

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৫ ১২:৩৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

শাকিব বিপ্লব ও সহযোগিয়াতায় হাফিজ স্বাধীন :: প্রেম-বিচ্ছেদে থাকে বিরহ বা বিষাদের ছায়া। কিন্তু যে কোন মৃত্যুর সংবাদ ঘিরে ধরে সাদা কাপড়ে শোকের বেড়াজালে। যদিও এই ধরাধামে জন্মিলে মৃত্যু হয়- একথা অবধারিত সত্য। কিন্তু সব মৃত্যু একমাত্র নিকট স্বজন ব্যাতিত অন্যদের মনকে নাড়া দেয় না। যেমন বরিশাল মিডিয়ায় অনেক দিন পর শোকে ধুমরে-মুচরে দিয়েছে যুব বয়সি সাংবাদিক আরিফিন তুষারের না ফেরার দেশে যাত্রার খবর। গত ৮ সেপ্টেম্বর সোমবার রাত সাড়ে ১০ টায় বরিশাল সদর রোডস্থ হাবিব ভবনের নিজ অফিস কক্ষে বুকের ব্যথায় ঢলে পড়ার পর শেবাচিম হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেন, যে সৃষ্টি করেছে সেই কর্তাই তাঁর হৃদপিণ্ড থামিয়ে দিয়েছে চিরতরে। কেনো বিধাতা এই অল্পবয়সি তরুণের জীবনের প্রাদপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে পরপাড়ে ডাক দিয়ে নিয়ে গেলেন তার রহস্য একমাত্র তিনিই যানেন।

কিন্তু আমরা সহকর্মী এবং তাঁর নিকট স্বজনরা জেনেছিলাম- ভেবেছিলাম এই যুবকের সংবাদপত্রের পথ-পক্রিমায় যাত্রা পথ অনেক দীর্ঘ হবে। একমাত্র সন্তান আরহাব ও স্ত্রী শানজিদাকে নিয়ে জীবন সংগ্রামের কঠিনতর দিন পাড় হয়ে সুদিন ছিল অনাগত। হয়েছিলও তাই। দেশের প্রথম সাড়ির দৈনিক পত্রিকা কালবেলায় বরিশাল ব্যুরো চীফের দায়িত্ব পাওয়ার পর ছন্নছাড়া এই যুবকের জীবনের গতিপথ পাল্টে যায়, সেই সাথে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রস্ফুটিত হয়েছিল। কিন্তু এই সুখ যে বেশিদিন সইবে না তা কে জেনেছিল? আমার যতুটুকু মনে পরে ২০০৮ সালের দিকে যখন আমি তৎসময়কার জনপ্রিয় এবং সাহসি পত্রিকা হিসেবে অল্প দিনে পাঠক মহলে আলোড়িত দৈনিক বাংলার বনে এক ঝাঁক তরুণের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশ করে, ঠিক তখন প্রায়ত সাংবাদিক দৈনিক ইত্তেফাকের ব্যুরো প্রধান লিটন বাশারের খালাতো ভাই হিসেবে এই তরুণ আমার কাছে আসতো এবং নানা আলাপচারিতায় নিজ জীবনের পরিকল্পনার নানাদিক তুলে ধরতো। কখনো কখনো ভাইয়া সম্মোধন করে বায়না ধরতো, সাংবাদিকতার আধুনিকায়নের ছোঁয়া কিভাবে পাওয়া যায়, সেই কৌশল জানার। সেই সাথে আমার লেখা ও সাহসের প্রশংসায় আমাকে এতটাই তুষ্ঠ করত যে, আমি ওকে নিজ ছোট ভাইয়ের মত দেখতে শুরু করি। নিজে নিজে কখন একান্তে ভাবি এই তরুণ হয়তো একদিন ভালো মিডিয়া কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত হবে।

জীবনে চলার পথে প্রত্যেক মানুষেরই ভুলত্রুটি থাকে। কেহই ফেরেস্তা নয়। ওর চলন-বলনে কিছু ভুল চোখে পরে। যা পরে নিজেই শুধরে নেয়। সাংবাদিকতার এই কঠিন জীবনে পোড়খাওয়া কিছু ঘটনাবলীর কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে। একটা সময় নিজ খালাতো ভাই লিটন বাশারের সাথে ওর দূরত্ব তৈরি হলেও পর্যয়ক্রমে তারা আবার দুইজনে এক মোহনায় মিলিত হয়। কিন্তু আঁচ করতে পারি ভাই লিটন বাশার বড়মাপের সাংবাদিক হলেও আরিফিন তুষারকে ভালো একটা যায়গায় পৌছে দিতে সহায়ক ভূমিকায় না রাখায় চাপা আফসোস বয়ে বেড়াতো। ভাই বলেতো কথা, রক্তের বাঁধন কি ছিন্ন হয়? আরিফিন তুষারকে একটি যায়গা করে দিতে লিটন বাশার সম্পাদিত আঞ্চলিক দৈনিক দখিনের মুখ পত্রিকায় একটি পদে বসিয়ে ভালো রিপোর্ট করার তাগিদ দিতে শুরু করেন। দূরন্তপনায় অব্যস্ত এই যুবককে কি সামাল দেয়া যায়। ইচ্ছা আছে কিন্তু সারাদিন হৈহুল্লায় মেতে থাকায় ভালো রিপোর্টিংয়ে পিছিয়ে পরতো তাঁর নিজ পত্রিকার সহকর্মীদের থেকে। নিয়তির কি খেলা দুই ভাইয়ের সম্পর্ক যখন মধুময় হয়ে উঠে, তখনি লিটন বাশার হঠাৎ নিজ গ্রাম চরমোনাইয়ের আবাসভূমির বাঁশবাগানের নিচে ঠাঁই নেয় হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে মৃত্যুর স্বাদ নিয়ে।

বরিশাল মিডিয়ার উজ্জ্বল নক্ষত্র লিটন বাশারের মৃত্যুও ছিল এক বড় অঘটন অন্তত বরিশাল মিডিয়া জগতে। শেষমেশ দেখা গেল দুই ভাইয়ের মৃত্যুযাত্রা যেন একই পথের পথিক হয়ে দাঁড়ালো। লিটন বাশারও মৃত্যুকালে এক শিশু পুত্র সন্তান রেখে যান। মারা যান হৃদক্রীয়া বন্ধ হয়ে সেই শেবাচিমে। আরিফিন তুষারের মৃত্যুও ঘটলো একই রকম। রেখে গেলেন দেড় বছরের এক শিশু পুত্র। কিন্তু জীবন চলার বাঁকে ব্যাতিক্রমতা এখানেই আরিফিন তুষারের জীবনে হঠাৎ পরিবর্তন ঘটলেও লেখালেখিতে বেশিমাত্রায় মনযোগ এবং প্রেসক্লাব নিয়ে সাংবাদিকতার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠায়। পরিচিত হয়েও উঠেছি বেশ অল্পদিনেই। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বরিশাল প্রেসক্লাবের কয়েক দফা দায়িত্বে থাকা সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক মতবাদ পত্রিকার সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন স্নেহ দিয়ে আগলে ধরে রাখায় দুজনের সম্পর্ক দুই ভাইয়ে রূপ নেয়ায় লিটন বাশারের শুন্যতা কিছুটা পূরণ করে এই যুবকের যেন নতুন উত্থান ঘটেছিল।

২০২৪ সালের শেষের দিকে দৈনিক কালবেলায় আরিফিন তুষার যোগদানের পর বেশকিছু সংবাদ প্রকাশ করে আলোচনায় আসে, সেই সাথে প্রেসক্লাবের বিভিন্ন পদে বার বার নির্বাচিত হয়ে আলোচনার টেবিলে নিজের নামের যায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি স্ত্রী শানজিদাকে নিয়ে সাংসারিক জীবন শুরু করলে এই দম্পত্তির ঘরে আলোকিত করে আসে পুত্র সন্তান আরহাব। এরপরই আরিফিন তুষার কিছুটা ব্যতিত্বময় ও কর্মজীবনের গুরুত্ব অনুধাবন করে আগামীর দিনগুলো সুখোকর করে তোলার কঠিনতর এক লড়াইয়ে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু বিধিবাম। সবকিছুই ওল্টো-পাল্ট হয়ে গেল গত ০৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা রাতে। যেন মেঘবিহীন আকাশ থেকে বজ্রপাতের মত সংবাদ ছড়িয়ে পরলো আরিফিন তুষার আর নেই। সংগত কারণে এই আধুনিক যুগে মূহুর্তের মধ্যে এ খবর ভাইরাল হয়ে যায় স্যোশাল মিডিয়ায়। সেই সাথে শোকের সাগরে ভাসতে থাকে ‘শত্রু থেকে মিত্র পর্যন্ত’। সকলে ভেদাভেদ ভুলে গেল, চোখ যেন অশ্রæসজল হয়ে টপটপিয়ে পানি পড়ছিল। না বল্লেই নয় মৃত্যুকালে তাঁর সাথে থাকা যুগান্তরের বরিশাল ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার অনিকেত মাসুদ যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পাথরে রূপ নিয়েছিল। সময়ের প্রেক্ষাপটে আফসোস হচ্ছিল বা প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যায় এক অকল্পনিয় শব্দ, হারে অকালে ঝড়ে গেল সদ্য ফুটান্ত গোলাপের পাপড়ির মত এই যুবক সাংবাদিক।

আরিফিন তুষারের ঘরে কান্নার রোল এতটাই উচ্চতর হয়ে উঠেছিল যে অনেকই নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলেন না। আরিফিন তুষারের লাশ রাতেই শেবাচিম হাসপাতাল থেকে নগরীর কলেজ এভিনিউ ভাড়া বাসায় নিয়ে আসার পর তার সহকর্মীরা যে যেখানে ছিল ছুটে আসে। তার শবদাহের চারপাশে দাঁড়িয়ে যেন স্মৃতি হাতরাছিল আরিফিন তুষারের সাথে ফেলে আসা সেই দিনগুলো সামনে চলে আসায়। কেউ কেউ যেন অপলোক সৃষ্টিতে তাঁর নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল সকাল বেলাওতো দেখা হল তুষারের সাথে (!)।

এই তুষার কি সেই তুষার? কিন্তু বাস্তবতা তো মানতেই হবে। সইতেই যে হবে শোক। কারণ এই নশ^র পৃথিবিতে একবার কেউ আসলে পরোপাড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে হবে ধর্মনিবিশেষ সকলকেই। তুষারের এই অকাল মৃত্যু সেই বাস্তবতাকে অনেকেই মানতে পারছিল না। এরপর রাতভর যা হবার তাই হচ্ছিল। একদিকে কান্নার শব্দ, অন্যদিকে তুষারের শবদাহ কিভাবে নিজ গ্রাম মেহেন্দিগঞ্জে নিয়ে যাওয়া এবং কোন বাঁশ বাগানের নিচে সমাধিস্থ করে বিদায় জানানো হবে তার সব আয়োজন চলছিল।

মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে প্রথমে নগরের আগরপুর রোডস্থ প্রেসক্লাব চত্বরে তার শবদাহ নিয়ে আসার পর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো শেষে অশ্বিনী কুমার হল সম্মুখে জানাজা নামাজে ঢল নামে সর্বস্তরের মানুষের। এরপর এই নগরকে বিদায় জানিয়ে নিথর তুষার গাড়ির ভিতরে পিছনের অংশে শাহিত আর সামনে তাঁর পিতা অর্থাৎ দাদার কোলে শিশু পুত্র আরহাব এবং শবদাহবাহী গাড়ির বহরে সাংবাদিক নেতা এসএম জাকির হোসেন ও কাজী আল মামুনের নেতৃত্বে অশ্রুসজল সহকর্মীরা ছুটে চলে জন্মভূমি মেহেন্দিগঞ্জের দিকে।

ঠিক সকাল ১১ টার দিকে এ বিদায় যে শেষ বিদায় তা কি দৃশ্যপট দেখে ভাবা যায়? তবুও শোকাতর মনকে শান্তনা তো দিতেই হচ্ছে কোন না কোন যুক্তির ছলাকলে। দুপুরে মেহেন্দিগঞ্জের আন্ধারমানিক ইউনিয়নের নিজ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে সমাধিস্থ করার পর নিথর আরিফিন তুষার মুখে কিছু না বললেও সাদা পোষকে আবৃত তার মুখোবয় যেন বলছিল তোমরা আমাকে ভুলো না।

তেমাকে ভোলাতো যাবেই না, কারণ তুমি যে স্মৃতি রেখে গেছো তাতো অনন্তকাল বয়ে বেড়াতে হবে স্বজন-সহকর্মীদের। কিন্তু শোক আর বেদনা একাকিত্ব হয়ে হৃদয়ে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে সে ব্যথাও কম কাতরাতে হবে না, তা জেনেও আমাদের শোকাতুর মনকে শক্ত করে থাকতে হবে তোমার কাছে অর্থাৎ না ফেরার দেশে যাওয়ার আগমূহুর্ত পর্যন্ত। কায়েমনে প্রার্থনা করি পরোপাড়ে তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো। সম্ভাবত যেমনটি রয়েছে চরমোনাইয়ের বাশ বাগানের নিচে শাহিত তোমারই অগ্রজ লিটন বাশার।

  1. আমরা অন্তত সংবাদকর্মীরা তোমার স্মৃতি স্মরণ করে ভাববো তুমি হয়তো বা বাসায় আছো, নয়তো বা কিছুক্ষণ পরেই কোথা থেকে আগন্তকের ন্যায় হঠাৎ উপস্থিত হবে কোন খবরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে। এই তো জীবন। এভাবেই উত্থান, এভাবেই বিদায় যা পৃথিবির বাস্তবতা। এমন বাস্তবতা মেনেইতো তোমার ভাই লিটন বাশারে মৃত্যুর শোক আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সৃষ্টি কর্তার কাছে কাঙ্গাল বিশেষ করে সংবাদকর্মীরা। পৃথিবি থেকে তোমরা দুই ভাই এবং সদ্য প্রয়াত দৈনিক আজকের বার্তার সম্পাদক কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল চলে চাওয়ায় বরিশাল মিডিয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাবে কে? এমন প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষার মাঝে হতো বা আবার কোন শোকের পাথর বুকে চেপে ধরবে কখন কে জানে। বাস্তবিক অর্থে এমন সময়কাল সমগত থাকলেও তোমরা দু’ভাই আমাদের মাঝে অনন্তকাল স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবে। এরূপ বরিশাল মিডিয়ায় অনেককে হারিয়ে অম্লান স্মৃতি আজও কাঁদায় আমাদের।