ঢাকারবিবার , ২৬ অক্টোবর ২০২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পটুয়াখালীতে অনুমোদন ছাড়াই চলছে শতাধিক ক্লিনিক, মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রোগীরা

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
অক্টোবর ২৬, ২০২৫ ১১:০৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিজস্ব প্রতিবেদক :: পটুয়াখালীতে অনুমোদন ছাড়াই চলছে শতাধিক ক্লিনিক, মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রোগীরা।

বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলাজুড়ে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলছে অনিয়মের মহোৎসব। বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে, কিন্তু সরকারি অনুমোদন বা লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে জেলার লাখো মানুষ প্রতিদিন পড়ছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। নিয়মিত পর্যাপ্ত সরকারি তদারকি না থাকায় এবং প্রভাবশালী মালিকদের ছত্রছায়ায় এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে পটুয়াখালী জেলায় গড়ে উঠেছে অর্ধ শত ডায়গনিক সেন্টার ও ক্লিনিক। মানছে না নিয়ম। নেই আবাসিক ডাক্তার, অভিজ্ঞ নার্স, বজ্র ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, ১০ বেডের পরিবর্তে ৩০ বেড আবার কিছু কিছু ক্লিনিকের সামনে রয়েছে পচা নর্দমা পুকুর,।সরকারি ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালে সেবা না দিয়ে তারা ব্যস্ত থাকে ক্লিনিক নিয়ে রোগীরা সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে গেলে তাদেরকে পাঠায় তাদের নিজস্ব ক্লিনিকে। সিজার অথবা যে কোন অপারেশনে টাকা নেওয়া হচ্ছে গলাকাটা।

অধিকাংশ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক গুলোর বড় অংশের শেয়ার জেলায় কর্মরত সরকারি ডাক্তার ও জেলা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মরত কর্মকর্তাগন। এসব ডাক্তার ও কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের রয়েছে একাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের মালিকানা, রয়েছে বিলাসবহুল একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট ও ভবনের মালিকানা, তাদের রয়েছে নামে বেনামে অঢেল সম্পত্তি। জেলার সাধারণ ও গরিব রোগীদের সরকারিভাবে সেবা না দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে এসব অনিয়ম করে থাকে। জেলার হাসপাতালগুলোর কর্মরত ডাক্তারগন তাদের হাসপাতালগুলোতে সিন্ডিকেট তৈরি করে স্ব স্ব বিভাগের রোগীগুলোর টেস্ট ও অস্ত্র পাচারের মতো গুরুতর চিকিৎসাগুলো তাদের প্রাইভেট ক্লিনিক এর মাধ্যমে করিয়ে থাকে যাতে তারা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে পারে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পটুয়াখালী জেলায় বর্তমানে ২৪০টি বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮১টির লাইসেন্স বৈধ, বাকি ১৫৯টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ বা অনুমোদনই নেই। অর্থাৎ জেলার মোট প্রতিষ্ঠানের দুই-তৃতীয়াংশই অবৈধভাবে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে যা রোগীর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে প্রতিনিয়ত।

উপজেলা ভিত্তিক পরিসংখ্যান বলছে, বাউফল উপজেলায় ৩৮টি, কলাপাড়ায় ৩৪টি, গলাচিপায় ৩০টি, দশমিনায় ১০টি, মির্জাগঞ্জে ১৩টি, দুমকিতে ১৩টি, পটুয়াখালী সদর উপজেলায় ৮টি, পৌর এলাকায় ৯০টি এবং রাঙ্গাবালিতে ৪টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।

তবে বাস্তবে এ সংখ্যাও আরও বেশি বলে মনে করেন জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠানই নাম পরিবর্তন করে বা নতুন বোর্ড ঝুলিয়ে পুরোনো অবৈধ কাঠামোর মধ্যেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে যেগুলো সরকারি কর্তৃপক্ষের তালিকাভুক্ত কিংবা নজরদারিতে নেই।

তালিকাভুক্ত বেআইনিভাবে পরিচালিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক গুলোর অধিকাংশের অবস্থান জেলা ও উপজেলা গুলোর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর আশেপাশে। জেলা সিভিল সার্জনসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মরত কর্মকর্তাদের নাকের ডগায় এসব অনিয়ম চলছে প্রতিনিয়ত। তবুও অদৃশ্য শক্তি কিংবা অনিয়মের কারণে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক গুলো বন্ধের কোন কার্যক্রম বা উদ্যোগ নেই।

জেলা বিভিন্ন স্থানের বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক গুলো ঘুরে দেখা যায়, জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অদূরে অবস্থিত রয়েল ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও পাশেই রয়েছে পটুয়াখালী হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। রয়েল ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠান দুটি ভবনে একই নামে পরিচালিত হচ্ছে। কাগজে দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠান দেখানো হলেও, বাস্তবে এটি একই মালিকানায় পরিচালিত একটি কেন্দ্র। ম্যানেজার দাবি করেন, তারা লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়ায় আছেন এবং সিভিল সার্জন কার্যালয় তাদের সম্পর্কে অবগত।

পটুয়াখালী পৌর শহরের বাস স্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত পটুয়াখালী ইসলামী চক্ষু হাসপাতাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদনই নেই। তবুও প্রতিষ্ঠানটি তিন বছর ধরে চোখের সার্জারি করছে। প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৫০ জন রোগী অপারেশন করা হয় বলে স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ। রোগীদের অনেকেই জানেন না প্রতিষ্ঠানটির কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। প্রতিষ্ঠান মূল ভিত্তি হচ্ছে তাদের নিজস্ব স্টাফদের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউনিয়নের হাট বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে রোগী সংগ্রহ করে অপারেশন করা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালানো।

এছাড়া পৌর শহরের বাধঘাট এলাকায় অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানে এমবিবিএস চিকিৎসক না থাকা সত্ত্বেও ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী একজন নারী রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। তিনি একাই রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষার সহ প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন যাতে তিনি এন্টিবায়োটি ঔষধ লেখার কথা স্বীকার করেন। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানে স্থায়ীভাবে কোন ল্যাব টেকনিশিয়ান ও টেকনোলজিস্ট পাওয়া যায়নি। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক মোঃ সুমন বলেন, আমরা বহু বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। ছোট প্রতিষ্ঠান তাই সব সময় স্টাফদের দরকার হয় না। আমার এক আত্মীয় এমবিবিএস পাশ করেছে তাকে শীঘ্রই এখানে বসাবো।

একইভাবে শহরের ছোট চৌরাস্তায় একটি ভবনের ফ্লোর জুড়ে অবস্থিত ২০২৩-২৪ এ মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া নিউরন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে বেশ কয়েকজন সিজারিয়ান রোগে ভর্তি থাকলেও কোন আবাসিক ডাক্তার পাওয়া যায়নি। তবে একজন নার্স ও রিসিপশনিস্ট সহ একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান পাওয়া যায়। তারা বলেন, আবাসিক মেডিকেল অফিসার সকালে ও বিকালে দুইবার রোগী এসে দেখে চলে যান। পুরোপুরি নির্দেশ মেনে কোন ক্লিনিক চালানো সম্ভব নয়।

গলাচিপা উপজেলার পূর্ব বাজার মেডিসিন মার্কেটে মর্ডান কম্পিউটারাইজ ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে কাগজে-কলমে যার মেয়াদ শেষ হয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। কিন্তু সারে জমিনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নাম দেখা যায় মডার্ন ক্লিনিক যা এটি আবাসিক ভবনে অবস্থিত। ভিতরে একজন সিজারিয়ান রোগীকে রক্ত দিয়ে সিজারের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। একজন নারী চিকিৎসক সেখানে রোগী দেখে টেস্ট দিচ্ছেন এবং কিছু রোগীদেরকে হাসপাতাল রোডে অবস্থিত দি নিউ লাইফ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিজার করার জন্য পাঠানো হচ্ছে।

গলাচিপা হাসপাতাল রোডে অবস্থিত দিয়ে নিউ লাইফ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার যার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০২৩ ২৪ অর্থবছরে। সরে জমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, সি ক্যাটাগরির একটি ক্লিনিকে দুটি ছোট রুমে গাদাগাদি করে রোগী ভর্তি রয়েছে প্রায় ১৫ জন। এছাড়া তাদের আরো ১৫ টির মতো বেড রয়েছে কিন্তু সরকারী অনুমোদন আছে মাত্র ১০টি বেডের। এছাড়া ক্লিনিক ভবনের সামনেই একটি নর্দমা যুক্ত, বেরিকেট ছাড়া পুকুর রয়েছে যা সব সময় দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং অত্যন্ত অনিরাপদ।

ওই ক্লিনিকে ভর্তি সিজারিয়ান রোগীর মা রেনু আক্তার বলেন, আমি রাঙ্গাবালী থেকে এসেছি। সিজারের চুক্তি ১৪ হাজার টাকা এছাড়াও ঔষধ ও অন্যান্য খরচ নিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা যাবে। আমি নিজে তিন কন্যা সন্তানের মা আমাকে কোনদিন সিজার করতে হয় নাই কিন্তু এই বাচ্চা আমার বড় মেয়ের ঘরের প্রথম নাতি। ডাক্তার দেখানোর সাথে সাথেই বলে সিজার করতে হবে।

ম্যানেজার শ্রী মলয় বাবু বলেন, আমি শুধু ম্যানেজার তবে অনুমোদন সংক্রান্ত কোন ব্যাপার আমার জানা নেই। কাগজ দেখে আপনাকে বলতে পারব।

গলাচিপা সামুদাবাদ উদয়ন স্কুলের পাশে অবস্থিত নাইমা কবির ডায়াগনস্টিক এন্ড ক্লিনিক যার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। সরে জমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিলুফা বেগম নামে এক মধ্যবয়স্ক নারী যিনি জরায় মুখে টিউমারের অপারেশন হয় ১৫ দিন পূর্বে। অপারেশন পরবর্তী ৪ দিন ভর্তি থেকে বাড়ি চলে যায় কিন্তু ১১ দিন পর সেলাইতে ইনফেকশন হওয়ায় পুনরায় একই ডাক্তারকে দেখানোর জন্য এসে ভর্তি হয়। কিন্তু এবার আর ডাক্তার দেখা মেলেনি তবে ওই ক্লিনিকের বেডে শুয়ে আছে। এ ব্যাপারে ওই ক্লিনিকের মালিক ডাঃ নাইমা কবিরের বক্তব্য চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

একজন স্বাস্থ্যকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সকল স্থানে এভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে তবে আইনগত ও অনুমোদন সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের হাতে থাকে। সাধারণ স্বাস্থ্য কর্মীরা শুধু বেতনভুক্ত কর্মচারী।

পটুয়াখালীর প্রতিটি এলাকায় সরকারি হাসপাতালের পরিসেবা সীমিত হওয়ায় মানুষ বাধ্য হয়ে এসব বেসরকারি ক্লিনিকেই যাচ্ছেন। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাচ্ছে না এমবিবিএস ডাক্তার, প্রশিক্ষিত নার্স ও সঠিক ল্যাব প্রযুক্তি। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স দেখিয়ে প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে চলছে বছরের পর বছর।

ওদিকে জেলার কিছু সরকারি ডাক্তাররা বেতনের পাশাপাশি ক্লিনিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে হয়েছেন বিত্ত বৈভবের মালিক। অধিকাংশ ডাক্তারগণের রয়েছে বহুতল ভবন, একাধিক এপার্টমেন্ট ও একাধিক প্লট।

শুধুমাত্র পৌর শহরের হাউজিং এস্টেটের ভিতরে ঘুরে দেখা যায়, পটুয়াখালী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের ডাঃ রফিকুল ইসলামের রয়েছে নিজস্ব ৮ তলা নির্মাণাধীন ভবন ভবন। ডাঃ মশিউর রহমানের নামেও রয়েছে আরেকটি ৮তলা নির্মাণাধীন ভবন, ডাঃ সেলিম মাতুব্বর ও ডাঃ হাবিবুর রহমান এর রয়েছে একাধিক প্লট। এছাড়া ওই হাউজিং স্টেটে আরো বেশ কয়েকজন কর্মরত ডাক্তার ও অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তারদের প্লট ও ভবন রয়েছে বলে জানা যায়। এর বাহিরে ডাঃ সিদ্ধার্থ নারায়ণের রয়েছে ৬ তালা ভবন একাধিক এপার্টমেন্ট, ক্লিনিক ও হাসপাতাল। এ রয়েছে এছাড়া প্রত্যেকের রয়েছে নিজের শো ক্লিনিক ও হাসপাতাল।

রোগী হামিদা বেগম বলেন, আমি পৌর শহরের বাধঘাট এলাকায় পপুলার ডায়াগনস্টিকে রক্তের পরীক্ষা করাই, রিপোর্ট ভুল আসায় পরে ঢাকায় গেলে ডাক্তার বলেন রিপোর্টই ভুয়া। এতে আমি ব্যপক হয়রানির শিকার হয়েছি তবে অভিযোগ দেয়ার মতো কাউকে পাই নাই।

অন্যদিকে, বিভিন্ন ক্লিনিকের মালিকরা দাবি করছেন, প্রতিষ্ঠান শুরু করার পর অনুমোদন পেতে এবং পরবর্তীতে নবায়ন করতে ব্যাপক হয়রানির শিকার হতে হয়। সরকারি দপ্তরগুলো থেকে বিনিময় ছাড়া সহজে কোন কিছু পাওয়া যায় না। তাই প্রয়োজনে স্থানীয় ক্ষমতাশীল ও প্রভাবশালী শেয়ার নিতে হয়।

গলাচিপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ মেজবাহ উদ্দিন বলেন, বেসরকারি ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতাল গুলো সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার আমাদের সিভিল সার্জন নিজে নিয়ন্ত্রণ করেন। এরপরও আমার উপজেলায় যদি কোন অনিয়ম ধরা পড়ে সে ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শরীরের রক্ত পরিবর্তন ও ১০ সয্যা বেডের অনুমোদনে তার অধিক রোগী ভর্তি এসব আইনের ব্যত্যয়। অবশ্যই তাদের ব্যাপারে খতিয়ে দেখব।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, গত দুই বছরে জেলায় মাত্র কয়েক দফা পরিদর্শন অভিযান হয়েছে। সে অভিযানে কিছু প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন না থাকায় নোটিশ দেওয়া হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের জনবল কম, কিন্তু প্রতিষ্ঠান শত শত। নিয়মিত তদারকি সম্ভব হয় না।

তথ্য অনুযায়ী, গত দুই অর্থবছরে জেলায় মাত্র ৭টি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও ১১টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স বাতিলের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে একটিও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি। বরং যেগুলোর লাইসেন্স বাতিল হওয়ার কথা ছিল, সেগুলোও ‘নতুন নামে’ আবার চালু হয়েছে।

পটুয়াখালীতে একাধিক প্রতিষ্ঠানে একই চিকিৎসক বা ল্যাব টেকনোলজিস্টের নাম ব্যবহার করে লাইসেন্স নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসকরা গোপনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হিসেবে কাজ করছেন। এতে একদিকে সরকারি চাকরির বিধি লঙ্ঘন হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটও বাড়ছে।

একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, প্রভাবশালী ডাক্তার বা মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই রাজনৈতিক চাপ আসে।

এই অনিয়মের সরাসরি শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ভুল রিপোর্ট, ভুয়া প্রেসক্রিপশন, সংক্রমণ ছড়ানো, অস্ত্রোপচারের সময় জটিলতা। সব মিলিয়ে প্রতিদিনই ঘটছে অঘোষিত দুর্ঘটনা। তবে ভুক্তভোগীরা ভয় বা প্রভাবের কারণে মুখ খুলতে সাহস পান না।

পটুয়াখালী মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার ছেলে শহরের একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে পায়ের অস্ত্রোপচার করায়, পরে সংক্রমণ হয়ে আবার ঢাকায় নিতে হয়েছে। খরচ হয়েছে তিনগুণ।

মেডিকেল কলেজের সাবেকসহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শের আলী মর্তুজা (চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ) বলেন, অপ্রশিক্ষিত লোক দিয়ে চিকিৎসা করানো হচ্ছে এটা সরাসরি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বড় বিপর্যয় ঘটবে।

একই মত প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সাবেক কর্মকর্তা, যিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় বাণিজ্যিকীকরণ ঠেকাতে হলে কঠোর নজরদারি ও আইন প্রয়োগ প্রয়োজন।

অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিকের লাইসেন্স ২০২৩–২৪ অর্থবছর সহ এর আগেই শেষ হয়েছে, কিন্তু নবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেই। তবুও এসব প্রতিষ্ঠান অনায়াসে পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি কিছু প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের নোটিশ পাওয়ার পরও উচ্চ পর্যায়ের প্রভাব খাটিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

পটুয়াখালী সিভিল সার্জন ডাঃ খালিদুর রহমান মিয়া বলেন, আমরা ফাইনাল লিস্ট এখনো করতেছি সব জায়গা থেকে। ৪টা উপজেলা হয়ে গেছে বাকিগুলো হয়ে যাবে যে কোন সময়। বর্তমানে বাচ্চাদের ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলতেছে এজন্য কাজটি দেরী হচ্ছে। আমার সাথে ডিসি স্যারের কথা হয়েছে, বাকি উপজেলাগুলো শেষ করেই অভিযানে বের হবো

এই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জেলার স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। মানুষ চিকিৎসার জন্য এখন ঢাকামুখী হচ্ছে, যার ফলে খরচ ও ভোগান্তি দুই-ই বাড়ছে।

স্থানীয় সমাজকর্মী মোঃ সেলিম বলেন, পটুয়াখালীর মানুষ চিকিৎসার নামে প্রতারিত হচ্ছে, অথচ প্রশাসন নিরব দর্শক।

জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে নিয়ন্ত্রণ কার্যত ভেঙে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সুবিধাভোগী। ফলে বিগত দিনে অভিযান হলেও তা দেখানো অভিযান হয়ে দাঁড়ায়।

বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের দাবি, অবিলম্বে জেলার সব প্রতিষ্ঠান যাচাই করে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা, একাধিক প্রতিষ্ঠানে একই চিকিৎসক নিয়োগ বন্ধ, সরকারি-বেসরকারি যৌথ মনিটরিং টিম গঠন, এবং নিয়মিত জনসচেতনতা কার্যক্রম চালু করা।

পটুয়াখালী জেলায় বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে উঠছে, অথচ রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় কেউই নিচ্ছে না। লাইসেন্সবিহীন ও অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন এই জেলায় চিকিৎসা হবে ভাগ্যের ওপর নির্ভর।