
আসাদুজ্জামান মুরাদ :: সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে একটি মহৎ পেশা—সত্যের পক্ষে কলম ধরার অঙ্গীকার যেখানে জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবতার কঠিন মাটিতে দাঁড়ালে দেখা যায়, বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকতার জগতে, এই পেশা আজ জীবন-জীবিকার চরম সংগ্রামে পরিণত হয়েছে।
গ্রামে, উপশহরে কিংবা জেলা শহরে কর্মরত সাংবাদিকদের জীবনযাত্রা অনেক ক্ষেত্রেই দুঃসহ। সংবাদ সংগ্রহ, পরিবহন, ইন্টারনেট, প্রিন্ট, ক্যামেরা—সবকিছুর খরচ নিজের পকেট থেকেই বহন করতে হয়। অথচ মাস শেষে হাতে আসে “সম্মানী” নামে এমন এক সামান্য পরিমাণ অর্থ, যা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজন মেটানোই দুঃসাধ্য।
একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন,
> “আমরা কলম চালাই সমাজ বদলের আশায়, কিন্তু অনেক সময় পেট চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে। সাংবাদিকতা এখন একপ্রকার আত্মত্যাগের নাম।”
আরেকজন তরুণ প্রতিবেদকের ভাষায়,
> “মাসে হাতে আসে ২-৩ হাজার টাকা। এর ভেতর দিয়ে সংসার চালানো বা সমাজে টিকে থাকা অসম্ভব। ফলে অনেকেই বাধ্য হয় এমন কিছু কাজে, যা সংবাদপেশার মান ক্ষুণ্ণ করে।”
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ;
গণমাধ্যম বিশ্লেষক অধ্যাপক মো. ফারুক আহমেদ মনে করেন,
> “মফস্বল সাংবাদিকতার মূল সমস্যা হলো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা। সংবাদকর্মীরা পেশাদার হলেও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ‘ফ্রিল্যান্সার’ ভেবে চলে। সাংবাদিকদের জন্য কোনো বেতন কাঠামো নেই, নেই পেশাগত নিরাপত্তা।”
সিনিয়র সাংবাদিক রাশেদ খান বলেন,
> “এই পেশায় শতকরা ২% সাংবাদিক ন্যূনতম টাকায় বেতন পান, বাকিদের কাজ চলে নিছক ভালোবাসা আর আত্মসম্মানের ওপর। অথচ, এই শ্রেণিটিই মাঠের মানুষ—যারা দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অনিয়ম তুলে ধরেন।”
সমাজবিজ্ঞানী ড. নূরজাহান বেগমের মতে,
> “অর্থনৈতিক চাপ একজন সাংবাদিককে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। যাদের পরিবার, সন্তান, দায়িত্ব রয়েছে—তারা বাধ্য হয়ে বিকল্প পথ খোঁজেন। তখনই জন্ম নেয় অপসংবাদিকতা।”
অপসংবাদিকতার মূলে দারিদ্র্য ;
অপসংবাদিকতা বা সাংবাদিকতার নৈতিক স্খলন কেবল ব্যক্তিগত ইচ্ছার ফল নয়; এর পেছনে রয়েছে কাঠামোগত দারিদ্র্য, প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম ও পেশাগত অবমূল্যায়ন। কেউ কেউ হয়তো ক্ষমতা বা অর্থের লোভে এ পথে যান, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা “বাঁচার তাগিদে”।
করণীয় ;
একজন সাংবাদিক হিসেবে লেখকের অভিমত—
> “অপসংবাদিকতা বন্ধ করতে হলে আগে সাংবাদিকদের জীবনমান নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও আত্মনির্ভর হতে হবে। জীবন-জীবিকার জন্য ছোটখাটো ব্যবসা বা উদ্যোক্তা উদ্যোগ গ্রহণ করলে পেশার প্রতি নিষ্ঠা বজায় থাকে, সম্মানও অটুট থাকে।”
সাংবাদিকতা শুধু পেশা নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা। কিন্তু সেই দায় যদি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কাছে হেরে যায়, তবে সমাজ হারাবে তার দর্পণকে। তাই এখনই সময়—মফস্বল সাংবাদিকদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। কলম সৈনিকদের বাঁচাতে হলে, তাদের কলমের পেছনে থাকা মানুষটাকেও বাঁচাতে হবে।


