ঢাকাসোমবার , ১০ নভেম্বর ২০২৫

বরিশালে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের ভুয়া ঋণ কেলেঙ্কারি

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
নভেম্বর ১০, ২০২৫ ১১:১৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

মির্জা রিমন :: বরিশালে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের ভুয়া ঋণ কেলেঙ্কারি : ভুয়া নথিতে ২৭টি অভিবাসন ঋণ অনুমোদন, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ।

প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক বরিশাল শাখায় অভিবাসন ঋণের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে চলছিল এক গোপন জালিয়াতির নাটক। অন্যের নামে ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় শাখার চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে ব্যাংকের তদন্ত কমিটি।

গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নগরীর করিমকুটির শাখায় সপ্তাহব্যাপী তদন্ত শেষে কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে ২৭টি অভিবাসন ঋণই ছিল ভুয়া। আর প্রতিটি ঋণের কাগজপত্র তৈরি থেকে অনুমোদন পর্যন্ত ধাপে ধাপে এই চারজনই যুক্ত ছিলেন। অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের মতো সংগঠিত এই জালিয়াতির চক্র কীভাবে মাসের পর মাস শাখার ভেতরেই সক্রিয় ছিল, সে চিত্রও উঠে এসেছে তদন্ত রিপোর্টে। গত ২ মাস আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনের এক সিকিউরিটি গার্ড সুমন হাওলাদারের অভিযোগের পরই তদন্তে জালিয়াতির বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের বাসিন্দা ঢাকা সিটি করপোরেশনে কর্মরত সিকিউরিটি গার্ড সুমন হাওলাদার অপর একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর নামে আগেই প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক বরিশাল শাখায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি অভিবাসন ঋণ অনুমোদিত হয়েছে। তিনি বলেন, “দুই মাস আগে একটি বেসরকারি ব্যাংকে ঋণের আবেদন করলে জানা যায়, আমার নামে আগেই ঋণ রয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি গত ৭ জানুয়ারি প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক বরিশাল শাখায় আমার নামে ঋণ পাশ করা হয়। নথিতে আমার এনআইডি, পাসপোর্ট ও ভুয়া ভিসা ব্যবহার করা হলেও ছবিটি ছিল ভিন্ন ব্যক্তির।” বিষয়টি নিয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে সুমন হাওলাদার বরিশাল শাখায় যোগাযোগ করলে ঘটনার সত্যতা প্রকাশ পায়। এনিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক দেশ জনপদ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বরিশাল করিমকুটির শাখায় সপ্তাহব্যাপী তদন্ত পরিচালনা করে কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে ২৭টি ভুয়া অভিবাসন ঋণে সরাসরি যুক্ত চার কর্মকর্তা-কর্মচারী নাম উঠে আসে। এদের মধ্যে ৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী জালিয়াতির ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপরজন দায়িত্ব অবহেলার কারনে অভিযুক্ত হয়েছেন। তদন্তে দেখা গেছে, ঋণের আবেদন থেকে অনুমোদন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই জাল নথিপত্র তৈরি, ভুয়া ভিসা সংযুক্তি, ছবিবদল ও নথি সত্যায়নের কাজ স্থানীয় চক্রের সহায়তায় সম্পন্ন হয়। শাখার ভেতর থেকেই কিছু কর্মকর্তা পুরো প্রক্রিয়া সমন্বয় করতেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সিনিয়র অফিসার তামান্না আফরিন ১২টি ভুয়া অভিবাসন ঋণের নথি প্রস্তুত ও অনুমোদনে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিলেন। নথিপত্র পর্যালোচনায় তার সম্পৃক্ততা স্পষ্ট হওয়ায় তাকে দায়িত্বে অবহেলা ও অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই ঘটনায় তাকে বরিশাল থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার তামান্না আফরিন বলেন, “ঋণের আবেদন থেকে অনুমোদন পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে আমার দায়িত্ব ছিল এটি অস্বীকার করছি না। তবে আত্মসাতের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমি কোনো অনিয়ম বা আর্থিক লেনদেনে জড়িত নই। তদন্তে যা উঠে আসুক, তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেবে। আপনারা সংবাদ প্রকাশ করলে কী পরিবর্তন হবে জানি না, যত মন চায় নিউজ করেন”।

অন্যদিকে অফিসার খালিদ মাহবুব জাহানও তদন্তকারীদের নজর এড়াতে পারেননি। ৫টি ভুয়া ঋণের নথিতে সত্যায়নকারী কর্মকর্তা হিসেবে তার স্বাক্ষর পাওয়া গেছে। মূল নথি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত অবহেলা কিংবা সুবিধার বিনিময়ে নথি সত্যায়নের পরিস্থিতি ঘটানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তিনি এখনো বরিশাল শাখায় বহাল তবিয়তে আছেন। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের অফিসার খালিদ মাহবুব জাহান বলেন, “আমি জালিয়াতির সাথে জড়িত নই। তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে, যা সংশোধনের প্রক্রিয়ায় আছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরে জানাবো,” এ কথা জানিয়ে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

অভিযুক্তদের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর নাম শাখার নিরাপত্তা প্রহরী রিপন মণ্ডল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় তিনি ঘুষ গ্রহণসহ প্রতারক চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ঋণ জালিয়াতির পুরো প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতেন। ব্যাংকের সংবেদনশীল এলাকায় প্রবেশাধিকার থাকার সুযোগ তিনি অপব্যবহার করেছেন বলেও তদন্তে উঠে এসেছে। তাকে শাস্তিমূলক ঝালকাঠি শাখায় বদলি করা হয়েছে। ম্যানেজার জসিম উদ্দিন জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত না হলেও গুরুতর দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে তাকে বরিশাল থেকে পিরোজপুরে বদলি করা হয়েছে।

অভিযোগে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। তবে এ জবাবের পর ব্যাংক কি কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে, নাকি বিষয়টি ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যাবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে পুরো ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার ধারণা, এটি বিচ্ছিন্ন নয়; বরং শাখায় দীর্ঘদিন ধরে একটি অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক সক্রিয় ছিল।