নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী জসিমের সম্পদের পাহাড়, বেতন ২২ হাজার টাকা।
নগরীতে তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর আলিশান এক ভবনসহ রয়েছে বিপুল বিত্ত। কীভাবে তিনি এত সম্পদের মালিক হলেন সেটাই প্রশ্ন সবার। শুধু সম্পদ নয়, প্রভাবেও কম যান না বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ কেস সার্টিফিকেট শাখার ইনচার্জ জসিম উদ্দিন। অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে বিভিন্ন সময় তিনি তদন্তের মুখামুখি হয়েছেন। যখন যেখানে ছিলেন, সেখানেই বেপরোয়া দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ১৪ তম গ্রেডের সর্বসাকুল্যে ২২ হাজার টাকা বেতন স্কেল পাওয়া জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধান করে বিপুল সম্পদের সন্ধান মিলেছে মোঃ জসিম উদ্দিনের। বরিশাল নগরীর ২৫নং ওয়ার্ডস্থ বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের তুরাগ এলপিজি গ্যাস পাম্প সংলগ্ন কাঠাঁলতলা সড়কের মধ্যে সাড়ে ৬ শতাংশ জমির উপর সাড়ে ৪ তলার একটি আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন জসিম। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। ভবনটির বয়স ৪ বছর হলেও ভবনের নেম প্লেট কিংবা হোল্ডিং নাম্বার ঝুলায়নি জসিম। তার ধানগবেষনা এলাকায় রয়েছে অর্ধ কোটি টাকার মূল্যের জমি। শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে বেবিলন মেডিকেল সার্ভিসেস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রয়েছে শেয়ার। বরিশালের বাইরে ঢাকায়ও রয়েছে তার অর্থসম্পদ। পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে জমিসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।
জসিম উদ্দিন অবশ্য এসব সম্পদের কথা আংশিক স্বীকার করে বলেন, অফিসের কেউ হয়তো আমার বিরুদ্ধে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেছে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ভবনটি করেছি। তাছাড়া আমার ভাগ্নি শারমিন বেগম ভবনের মালিকানায় আছে। তারা ঢাকাতে বসবাস করেন। তার স্বামী আবুল কালাম আজাদ পুলিশের এসআই।
শারমিন বেগমের নম্বরে যোগাযোগ করা হলে মোবাইলের অপরপ্রাপ্ত থেকে শারমিন বেগম ভবনের মালিকানা নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ সময় তার স্বামী আবুল কালাম আজাদকে মোবাইল ধরিয়ে দিলে প্রতিবেদক ভবনে তাদের মালিকানা আছে কিনা প্রশ্ন করলে তিনিও মালিকানার বিষয়ে পরিস্কার কোন কিছু না বলে জসিম উদ্দিনের সাথে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ বছর পূর্বে প্রকল্পের আওতায় চাকরি শুরু করেন মোঃ জমিস উদ্দিন। গত ১৪ বছর পূর্বে তিনি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতের আওতায় আসেন। রাজস্ব খাতে আসার পর তিনি শেবাচিম হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে পথ্য বিভাগের স্টুয়ার্ড পদে বদলি করা হয়। বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত প্রবচনে বলা হয়েছে, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। এটা কথাটির যেন বাস্তবে রূপ দিয়েছেন জসিম উদ্দিন। তিনি পথ্য বিভাগের স্টুয়ার্ড পদে দায়িত্ব পেয়ে দুর্নীতিতে বেশ পটু হয়ে ওঠেন। কথায় আছে ‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার ঘুঘু তোমার বাঁধিব পরাণ’ অর্থাৎ প্রতিদিন পথ্য বিভাগ থেকে চুরি করে আসলেও ২০২৩ সালের মার্চ মাসে মাংস চুরি করে ধরা পড়ে যান জসিম উদ্দিন। মাংস চুরির ঐ ঘটনায় ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ আবাসিক সার্জন (সার্জারি) ডাঃ সৌরভ সুতারকে সভাপতি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ঐ মাসের ২৮ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় কমিটির তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। পরোবর্তিতে জসিমের চুরির সহযোগী প্রধান বাবুর্চি মোকছেল আলী সন্যামতকে বাবুগঞ্জ স্বাস্থ্য কমেপ্লক্সে বদলি করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারনে প্রধান অভিযুক্ত পথ্য বিভাগের স্টুয়ার্ড মোঃ জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে তৎকালীন সময়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে- জসিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়না। অদৃশ্য কারণে সবাই যেন নীরব। অদৃশ্য ক্ষমতার বলে জসিম বার বার পার পেয়ে যান। সর্বশেষ পথ্য বিভাগের স্টুয়ার্ড পদ থেকে প্রশাসন শাখা-৬ পুলিশ কেস সার্টিফিকেট শাখার ইনচার্জ হিসাবে ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী বদলি করা হয় জসিম উদ্দিনকে।
হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী জানান, নিয়ম-বহির্ভূতভাবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে জসিম উদ্দিনকে অতিব গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পুলিশ কেস সার্টিফিকেট শাখার ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে দেওয়া এই নিয়োগের ফলে জুনিয়র কর্মকর্তারা সিনিয়র হয়ে যান এবং সিনিয়ররা হয়ে যান জুনিয়র। এতে কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় আরও বলেন, জসিম উদ্দিন লাগামছাড়া দুর্নীতিবাজ কর্মচারী। তার বিরুদ্ধে পূর্বে একাধিকবার অনিয়মের তদন্ত করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো নিয়ম-বহির্ভূতভাবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে তাকে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পুলিশ কেস সার্টিফিকেট শাখার ইনচার্জ হিসাবে বসানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালে শেবাচিম হাসপাতালে ২২৬ জন কর্মচারী নিয়োগে জসিম উদ্দিনের তদবিরে ঝাড়ুদার নুপুর, খালেদা সহ প্রায় ১০ জন ব্যক্তি চাকরি পায়। যদিও ঐ ২২৬ জন কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠায় নিয়োগপ্রাপ্ত সকল কর্মচারীর নিয়োগ স্থগিত করেছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যরা নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পান। দুদকের তৎকালীন পরিচালক আকতার হোসেন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর শেবাচিমের তৎকালীন পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দিন ফারুক, উপ-পরিচালক ডা. শহীদুল ইসলাম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল জলিল সহ তিন নিয়োগ কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেন। দুর্নীতির অভিযোগে ২২৬ জনের নিয়োগ স্থগিত হওয়ার পর সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামে শেবাচিম হাসপাতাল ভাংচুর করেন নিয়োগপ্রাপ্ত কতিপয় কর্মচারীরা। যার ইন্ধনদাতা ছিলেন জসিম উদ্দিন। পরে অবশ্য আইনি লড়াই করে ঐ ব্যক্তিরা চাকরিতে যোগদান করেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে ২২৬ জন নিয়োগপ্রাপ্ত ঐ কর্মচারীর মধ্যে প্রায় ১০ জন প্রার্থীর কাছ থেকে বিপুল অংকের ‘বাণিজ্য’ করেন জসিম উদ্দিন। বিভিন্ন সময় অনেককে হাসপাতালে চাকরি দেয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়েছেন জসিম। তাদের বেশিরভাগ ব্যক্তিদেরই চাকরি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন জসিম। চাকরি না দিতে পারলেও হাতিয়ে নেয়া ঘুষের টাকা ফেরত না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। কয়েকজন ভুক্তভোগী বিভিন্ন মাধ্যম ধরে কিছুটাকা আদায় করতে পেয়েছেন বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা পত্রিকার পাতায় তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
একাধিক সূত্রের খবর অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা অবৈধ অর্থ দিয়ে নগরীর তুরাগ এলপিজি গ্যাস পাম্প সংলগ্ন কাঠাঁলতলা সড়কের মধ্যে সাড়ে ৪ তলা আলিশান বাড়িটি নির্মাণ করেছেন জসিম উদ্দিন। এছাড়া নামে বেনামে বরিশাল-ঢাকা সহ বিভিন্ন স্থানে সম্পদ অর্জন করেছেন জসিম। যা দুদক পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য বেড়িয়ে আসবে বলে ধারনা শেবাচিমের একাধিক কর্মচারীর।
এবিষয়ে জসিম উদ্দিনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাই আপনি আছেন কোথায় বলেন একসাথে চা খাব। পরোক্ষনে তার (জসিমের) পক্ষে কয়েকজন সাংবাদিক প্রতিবেদককে ফোন করে তার বিরুদ্ধে সংবাদটি প্রকাশ না করতে অনুরোধ রাখেন। একই সাথে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন হুমাহুম রেস্টুরেন্টে কফি খাওয়ার আহবান করেন।
শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলামের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য তার নাম্বারে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।