ঢাকাশনিবার , ২৬ অক্টোবর ২০২৪

বরিশাল সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
অক্টোবর ২৬, ২০২৪ ১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

স্টাফ রিপোর্টার :: বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ক্ষমতায় থাকাকালে বরিশালে লুটপাট ও দুর্নীতির এক অন্ধকার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় হওয়ায় সাদিক একসময় বরিশালের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করতেন।

ক্ষমতায় থাকাকালে তার নেতৃত্বে নগরীর প্রশাসনকে ভয়ংকর অবস্থায় নিয়ে যান। সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিকবিরোধী এবং ব্যবসায়ীরা তার শাসনামলে চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তিনি ক্ষমতা হারানোর পর তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে বরিশালবাসী দীর্ঘদিন ধরে চাপা ক্ষোভ। সাদিক আব্দুল্লাহর রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস তার পারিবারিক পরিচয় থেকে আসে।

 

তার বাবা, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে এবং বরিশাল-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি। রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে সাদিক ২০১৮ সালের বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করে মেয়র হন। পাশাপাশি বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের পদটিও দখল করেন। এ সময় নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে আওয়ামী লীগের কমিটিও দেন।

মেয়র পদে আসীন হওয়ার পর থেকে সাদিকের বিরুদ্ধে বহু অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তিনি নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের কারণে বাড়ি ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়ে কমিশন আদায় করতেন। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে তিনি ব্যবসায়ীদের কাছে কমিশন, ভবন নির্মাতাদের কাছে ফ্ল্যাট নিতেন।

নির্বাচনের পর সাদিক আব্দুল্লাহ নিজের দলের পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে নিয়োগ ছাড়াই বেতন দিতেন। এ ছাড়া নিজের পছন্দমতো ১৩৯ জনকে সিটি করপোরেশন থেকে বরখাস্ত করেন। তার শাসনামলে বিরোধী দল ও স্থানীয় জনগণ তার তাণ্ডবের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর হামলা, নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলায় জড়ানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

 

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘যদি তার নির্দেশ অনুযায়ী না চলা হতো, তাহলে বুলডোজার দিয়ে আমাদের ভবন ভেঙে দেওয়া হতো। বরিশালে তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পেতেন না।’ সাদিক আব্দুল্লাহ নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছয়জন অনুসারী দিয়ে পুরো নগরী পরিচালনা করতেন।

নগরের সব হাটবাজার, লঞ্চঘাট, খেয়াঘাট নিয়ন্ত্রণ করতেন তার অন্যতম অনুসারী নগর আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল। তিনি সাদিকের চাঁদাবাজির টাকা তুলতেন। বর্তমানে টুটুল ভারতে অবস্থান করছেন। শ্রমিক লীগ নেতা রঈজ আহমেদ মান্না বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি করতেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, চাঁদা না দিলে কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়া হতো। এ ছাড়া ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত সিটি করপোরেশনের প্ল্যান পাস করানোর বিনিময়ে ঘুষ নিতেন।

সাদিকের ক্ষমতা ব্যবহারের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মঈন তুষার। তিনি অভিযোগ করেন, মহানগর আওয়ামী লীগ একতরফা গঠিত হয়েছে। সাদিক নিজের বলয় দিয়ে একতরফা দল চালাতেন, যেখানে ব্যক্তির স্বার্থের জন্য সংগঠনকে ব্যবহার করা হয়েছে। বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল হক হারুন বলেছেন, এখানে ব্যক্তি রাজনীতি হয়েছে।

হাসানাত পরিবার এই রাজনীতিকে শো করে ব্যবসা করেছে। এদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন সম্প্রতি একটি জাতীয় গণমাধ্যমে বলেন, নেতারা দল করেননি, ক্যাডার দিয়ে লুটপাট করছেন। গত বরিশাল সিটি নির্বাচনে সাদিককে সরিয়ে তার আপন চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহকে (খোকন সেরনিয়াবাত) মনোনয়ন দেওয়া হয়।

এ সময় তার পক্ষ হয়ে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় ছিলেন সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম। সে সময় বরিশালে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছিলেন, বরিশাল মুক্ত হয়েছে। বরিশালের মানুষ অনেক কষ্টে দিন পার করেছে। সাদিকের মতো ব্যক্তিদের কারণে বরিশালের জনগণ ভয় এবং শোষণের মধ্যে ছিল।’ সাদিকের বিরুদ্ধে বরিশাল ক্লাব দখলের অভিযোগ রয়েছে।

 

নিয়ম অনুযায়ী ক্লাবের সভাপতি হতে হলে ১০ বছরের সদস্যপদ প্রয়োজন, অথচ মাত্র তিন বছরের সদস্য থাকাকালীনই তিনি ক্লাবের সভাপতি হন। তিনি নিজের দলীয় লোকজনকে সদস্যপদ দিয়ে পুরো ক্লাবকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। সাদিকের বিরুদ্ধে আরও একটি বড় অভিযোগ হলো, তার দ্বৈত নাগরিকত্ব এবং বিদেশে সম্পত্তি গোপন করা।

তার মনোনয়নপত্রে যুক্ত আমেরিকার সম্পত্তির তথ্য গোপন করার অভিযোগ উঠেছে। সাদিক এবং তার স্ত্রী উভয়েই আমেরিকার নাগরিক এবং তাদের সেখানে বাড়ি রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিউ ইয়র্কের কুইন্স ভিলেজে তার একটি বাড়ি রয়েছে, যার ঠিকানা ৮৯-৬৮, ২১৬ স্ট্রিট, কুইন্স ভিলেজ, নিউ ইয়র্ক সিটি, ১১৪২৭।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সাদিক আব্দুল্লাহর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তবে এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা সফল হয়নি।