ঢাকামঙ্গলবার , ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
আজকের সর্বশেষ সবখবর

১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে কেন আসেননি জেনারেল ওসমানী

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪ ১:৩০ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিউজ ডেস্ক :: ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে কেন আসেননি জেনারেল ওসমানী?

১৬ ডিসেম্বর, আমাদের মহান বিজয় দিবস। এই দিনেই তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পন করে পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু বিজয়ের ৫৩ বছর পরেও একটা প্রশ্ন রয়েই যায়, সেই আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে কেন উপস্থিত ছিলেন না মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী? কেনই বা লে. জেনারেল নিয়াজি সাথে আত্মসমর্পনের দলিলে ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিত সিং অরোরা স্বাক্ষর করেন? তার মানে কি বিজয়ের প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশে আধিপত্ব বিস্তারের পরিকল্পনা ছিল ভারতের?
কে ছিলেন জেনারেল ওসমানী?
মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর জন্ম ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বর্তমান সিলেটে। ১৯৪০ সালের ৫ অক্টোবর তিনি বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চলে আসেন এবং কর্ণেল পদে থাকা কালীন ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার পর প্রবাসী সরকার গঠন করা হলে কর্নেল ওসমানীকে আবারও সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক করা হয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর তাঁকে জেনারেল পদে পদন্নোতি দেয়া হয়।

মুজিব নগর সরকারের সাথে জেনারেল ওসমানীর দ্বন্দ্ব
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক সেনা অফিসারের মতে জেনারেল ওসমানী ছিলেন একজন বিচক্ষণ সেনা কর্মকর্তা। তিনি অনেক রাজনৈতিক বিষয়ও খুব বিচক্ষণতার সাথে বুঝতে পারতেন। মেজর ডালিমের ‘আমি মেজর ডালিম বলছি’ বইতে উঠে আসে, কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ভারতীয় সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর হস্থক্ষেপ ছিলো দেশের রাজনিতীতে। তারা আওয়ামী লীগের মধ্যকার দলীয় কোন্দল, কোলকাতায় উচ্চাভিলাষী নেতাদের বেপরোয়া জীবন যাপন ইত্যাদি বিষয়ের সুযোগ নিচ্ছিলো। জেনারেল ওসমানী এই সব কিছুই জানতেন। তার কমান্ডে যুদ্ধ করা অনেক সেনা কর্মকর্তাই বলেন, জেনারেল ওসমানীর সাথে মুজিব নগর সরকারের অনেক বিষয়ে মতের অমিল ছিলো কিন্তু তবুও তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

১৬ ডিসেম্বর কি ভারতের বিজয়?
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পন করে, তখন সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে দলীলে স্বাক্ষর করার কথা ছিল জেনারেল ওসমানীর। কিন্তু তার স্বাক্ষর তো দূরের কথা, তিনি অনুষ্ঠানেই উপস্থিত ছিলেন না। তার পরিবর্তে বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন তার সেকেন্ড ইন কমান্ড গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার। কিন্তু তার উপস্থিতিটাও ছিল নাম মাত্র, এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এমনকি প্রচলিত ছবির মধ্যেও দেখা যায়না এ.কে. খন্দকারকে। অনেক বিশ্লেষকের মতে এমন করার প্রধান কারণ ছিলো এই পুরো যুদ্ধটাকে ভারতের নিজেদের দাবি করা। যার প্রমাণ পাওয়া আত্মসমর্পনের দলিলেও! আত্মসম্পর্পনের দলিলে মোট ৩টি অনুচ্ছেদ ছিলো যার প্রথমটিতে লেখা ছিলো, “পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেছে”। যদিও লেখার কথা ছিলো মুক্তি বাহিনীর কাছে বা মিত্র বাহিনীর কাছে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, “দলিলে স্বাক্ষর করা মাত্র পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড লে. জেনারেল জগজিত সিং অরোরার আওতায় চলে আসবে” যদিও উচিৎ ছিলো, যৌথ বাহিনীর আওয়তায় বা মুক্তিবাহিনীর আওতায় চলে আসা। অর্থাৎ, বুঝাই যাচ্ছে এই আত্মসমর্পনের দলিল একতর্ফাভাবে ভারত নিজের পক্ষে লেখে। এছাড়াও পরবর্তীতে বিভিন্ন ভারতীয় সিনেমা বা রাজনৈতিক বক্তব্যে দাবি করা হয় ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। যার প্রমাণ আবারও পাওয়া যায় আজ সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টে। পোস্টে তিনি লেখেন ১৬ ডিসেম্বর দিনটি ভারতের জন্য এক অসাধারণ বিজয়ের দিন!

আওয়ামী লীগের হাতে জেনারেল ওসমানীর ইতিহাস বিকৃতি
শুধু ভারত না, গত ১৬ বছরে বাছরে বাংলাদেশের ভেতরেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস প্রচন্ড রকম বিক্রিত করা হয়েছে। পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধুমাত্র একটি দল ও একজন মানুষকে কেন্দ্র করে করা হয়েছে। সেই বিশ্লেষণে জেনারেল ওসমানীর অনুপস্থিতি নিয়ে একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করানো হয়। তাতে বলা হয়, যেহেতু পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে তাদের সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে তাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানিক’শ উপস্থিত ছিলেন না, তাই প্রোটকল অনুযায়ী জেনারেল ওসমানীও উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু আসলেও কি তাই? এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের নেতারা জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে অসম্মানমূলক বক্তব্যও দেন

বাংলাভিশনের গুগল নিউজ ফলো করতে ক্লিক করুন
১৬ ডিসেম্বর কেন এলেন না জেনারেল ওসমানী?
মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিম, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ অনেকেই বলেন, সেদিন জেনারেল ওসমানী সিলেট ছিলেন এবং তিনি একটি হেলিকপ্টারে করে রওনাও হয়েছিলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। তার সাথে একই হেলিকপ্টারে ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কিন্তু ভূমি থেকে সেই হেলিকপ্টারে গুলি করা হয় এবং সেটি একটি মাঠে জরুরি অবতরণ করে। তাই জেনারেল ওসমানীর আর ঢাকায় থাকা হয়নি। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে হেলিকপ্টারে গুলি লাগাটা কোন অস্বাভাবিক বিষয় না। কিন্তু বিজয়ের ২ দিন আগে, অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর সিলেট শত্রুমুক্ত হয়। সিলেটের মতো এক মুক্তাঞ্চলে বিজয়ের ঘোষণা আসার পরে ঠিক কারা জেনারেল ওসমানীর হেলিকপ্টারকে লক্ষ করে গুলি ছুড়েছিল তা এখনও পরিষ্কার না।

জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন। তিনি সারা জীবন কাজ করে গেছেন দেশের মানুষের কল্যাণে। এমনকি মৃত্যুর আগে তিনি তার মোট সম্পদের ৪ ভাগের তিন ভাগ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের সাহায্যের জন্য দিয়ে যান আর বাকি টাকা সিলেটের কল্যাণের জন্য। অথচ তাঁকেই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বার বার। জেনারেল ওসমানী হয়ত ভারতের আধিপত্য বিস্তার ও মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের দাবি করার পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন আর সে জন্যই তাঁকে মহান বিজয়ের মুহূর্তের সাক্ষি করাই হয়নি। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে বেরিয়ে আসবে আসল ইতিহাস।