
নিউজ ডেস্ক :: বরিশাল মহানগর বিএনপির বর্তমান ও সাবেক নেতারা কয়েকভাগে বিভক্ত হওয়ায় দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। দলীয় কর্মসূচির ক্ষেত্রেও বর্তমান ও সাবেকরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পৃথক পৃথকভাবে পালন করায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা জানান, যোগ্য নেতৃত্ব না থাকায় কেউ কাউকে মানছেন না। অতীতে হেভিওয়েট নেতাদের ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে বর্তমানে। এ নিয়ে সম্প্রতি বিএনপির স্থানীয় একাধিক নেতা অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বর্তমান কমিটি কাউন্সিল প্রশ্নে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা মানছেন না বলে অভিযোগ করে আসছেন বর্তমান ও সাবেক নেতারা।
সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে মহানগর বিএনপি প্রধানত তিন ধারায় বিভক্ত। বর্তমান আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের একটি অংশ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা নাসরিনসহ অপর যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যদের একটি অংশ এবং মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদের একটি অংশ।
দলীয় সূত্র জানায়, মহানগর বিএনপির কোন্দল দেখা দেওয়ায় গত বছরের ২৫ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা আসে কেন্দ্র থেকে। ঐ চিঠিতে ৯০ দিনের মধ্যে সম্মেলন শেষ করে কমিটি চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্র। পুরো বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুকে। কিন্তু প্রস্তুতির শুরুতেই দেখা দেয় নেতৃত্বের কোন্দল। ৩০ নভেম্বর দলীয় কার্যালয়ে সভা আহ্বান করা হলেও অনুপস্থিত থাকেন অধিকাংশ সদস্য। সেখানে মহানগরের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি ভেঙে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি করার প্রস্তাব করেন সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার। সরাসরি সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন। এরপর বিরোধ চরম আকার ধারণ করলে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি বরিশাল মহানগর বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সাবেক ছাত্রনেতা বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুনকে।
ইতিমধ্যে আব্দুল আউয়াল মিন্টু, হাসান মামুন এবং সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানসহ মহানগর বিএনপির বিবাদমান নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একাধিক বৈঠক করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। সর্বশেষ গত সপ্তাহে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক ও সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় মহানগর বিএনপির বিলুপ্ত ৩০টি ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যদের সমন্বয়ে আটটি টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলোর দায়িত্বে রয়েছেন মোট ৩৯ নেতা। ঐ দিনই পালটা বিজ্ঞপ্তিতে মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন জানান, মহানগরের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন হাসান মামুন। হাসান মামুনের অনুপস্থিতিতে ওয়ার্ড কমিটি করার লক্ষ্যে টিম গঠন করায় আমরা হতবাক হয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে মহানগরের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি করার ক্ষেত্রে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির মাধ্যমে টিম গঠন করতে হবে। এই টিম তারা মানেন না।
সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজধানীতে বিবাদমান মহানগর বিএনপির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠকে বসেন সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হাসান মামুন, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানসহ অন্যরা।
সভা শেষে কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান জানান, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল, পদ-পদবি নিয়ে মতানৈক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বৈঠকে মহানগর বিএনপির বিবাদমান নেতৃবৃন্দ তারেক রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের পর কাউন্সিলের মাধ্যমে মহানগর বিএনপি গঠিত হবে প্রশ্নে সকলেই ঐক্যমত পোষণ করেন। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হাসান মামুন ইত্তেফাককে জানান, বরিশাল মহানগর বিএনপির সার্বিক পরিস্থিতি তিনি ও দায়িত্বশীলরা ওয়াকিবহাল রয়েছেন। যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং সকলকে আনুষ্ঠানিকভাবেই তা অবহিত করা হবে।
নাসরিনসহ অপর নেতৃবৃন্দের চাপে ঢাকায় শুক্রবারের বৈঠকের পর ফারুক-জিয়া বিরোধীদের মধ্যে স্বস্তি এসেছে। ঢাকায় বৈঠকে থাকা একাধিক নেতা ও মাঠ পর্যায়ের একাধিক নেতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যম কর্মীদের মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানিয়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কঠোর অবস্থানে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক জানান, সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক হাসান মামুন ঢাকায় বৈঠক করে জানিয়েছেন তিনি উপস্থিত থেকে কমিটি করবেন আমরা সে অপেক্ষায় আছি। আমাদের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই। একইভাবে সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার বলেন, ‘মহানগর বিএনপিতে কোনো কোন্দল নেই।’
মহানগর বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব ও ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন জানান, মহানগর আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে কোন্দল সৃষ্টি হচ্ছে। ওয়ার্ড কমিটি গঠনের লক্ষ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের লক্ষ্যে হাসান মামুনকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। তিনি এসে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করবেন এবং সকলেই তাকে সহযোগিতা করবে বলেও জানান তিনি।
কিন্তু এত কিছুর পরও বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক ও সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদারের সঙ্গে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা নাসরিনসহ অপর যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করায় এবং তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও নেতৃত্ব সংকট থাকায় কেউ কাউকে মানছেন না।
অন্যদিকে পদ-পদবি পেতে জোট বেঁধেছেন বরিশাল মহানগর বিএনপির সাবেক নেতারা। মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদের নেতৃত্বে সাবেক বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল নেতৃবৃন্দ জোট বেঁধে দলের কার্যক্রম পরিচালিত করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক এমপি মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারীরা।
জানা গেছে, মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটির ওপর তাদের ক্ষোভের কারণেই এ বিভক্তি। দীর্ঘ ৩০ বছর বরিশাল বিএনপির নেতৃত্বে ছিলেন মজিবর রহমান সরোয়ার। এ সময়কালে বরিশাল বিএনপিতে সরোয়ার অনুসারী একটি বৃহত নেতা-কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে সরোয়ার কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হন। এরপর ২০২১ ও ২০২৪ সালে বরিশাল মহানগর বিএনপির দুটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন হলেও ঐ দুই কমিটিতেই সরোয়ারের অনুসারীদের বাদ দেওয়া হয়। সরোয়ারের বিপুল কর্মী-সমর্থক ও বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদের সঙ্গে সমন্বয়ে রাজনীতির মাঠে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় বরিশালের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি হয়েছে।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ জানান, তিনি মহানগর ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ও সে সময়ের ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা বর্তমান কমিটির কার্যক্রমে হতাশ। কেননা দলে হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারীদের নানাভাবে পদ-পদবি দিয়ে ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। ফলে মহানগর বিএনপিতে নেতৃত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। সেজন্য সাবেক ও বর্তমান ত্যাগী নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় ও বর্তমানে দলের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
তিনি আরও জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি যখন সদস্য সচিব ছিলেন তখন ওয়ার্ড কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সাবেক ছাত্রনেতাদের প্রাধান্য দিয়েছিলেন। সাবেক ছাত্রনেতাদের ওয়ার্ড কমিটিতে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বর্তমানে তাদেরকে বাদ দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চলছে যা সাধারণ নেতাকর্মীরা মেনে নিবেন না।