
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক :: সরকারি ফেরিঘাট এবং ইজারাদারের খেয়াঘাট একই জেটিতে হওয়ায় ডাবল ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের হয়রানির অভিযোগ ইজারাদারের বিরুদ্ধে। প্রতিদিন এ নিয়ে কোনো না কোনো যাত্রী হচ্ছেন লাঞ্ছিত । আবার ফেরি আটকে রেখে চারটির পরিবর্তে ৭-৮টি কখনো ১০টি পর্যন্ত মোটরসাইকেল ও প্রায় ৪০-৫০ জন যাত্রী তুলে ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার রাঙামাটি নদীর গোমা সেতুর নিচে। এখানে ও কবাই ইউনিয়নের ডিসি রোড খেয়াঘাটে খেয়ালখুশি মতো বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন একাধিক যাত্রী। এ বিষয়ে যাত্রীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে ফেরির ইজারা বাতিল করে সরকারি তদারকিতে রাখা হয়েছে। কিন্তু এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইজারাদাররা বিভিন্নভাবে হয়রানি করছে যাত্রীদের। দু’প্রান্তের লাখো মানুষের দৃষ্টি তাই এখন গোমা সেতুর দিকে। নতুন করে স্পাম বসানোর কাজ শুরু হয়েছে এই সেতুতে। কোরবানির আগেই সেতু চালু হবার আশায় অনেকে মিষ্টিও বিতরণ করে মসজিদে দোয়ার আয়োজন করেছেন বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে গত ২৫ এপ্রিল এ চিত্র দেখা গেছে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুধল ইউনিয়ন ও চরাদি ইউনিয়নের গোমা সেতুর নিচের খেয়াঘাটে। আর বাড়তি ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা নিচ্ছে বলে একাধিক অভিযোগ কবাই ইউনিয়নের ডিসি রোড থেকে বাহেরচর বাজার বা ডিসিহাট খেয়াঘাটের বিরুদ্ধে। ফেরিতে কোনো সমস্যা দেখা দিলেই গোমা খেয়াঘাটের ভাড়াও বাড়িয়ে দেওয়া হয় বলে জানালেন এলাকাবাসী। তাছাড়া বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে ভাড়া বাড়ানো হয়। আগে এই ইজারা নিয়ন্ত্রণ করতেন চরাদি ইউনিয়নে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। এখন এটি চলে গেছে ওপারে দুধল ইউনিয়ন বিএনপি নেতাদের হাতে। তারা প্রথমে ফেরিসহ ইজারা নিয়েছিলেন। পহেলা বৈশাখের পর যাত্রীদের হয়রানি করার অভিযোগ পেয়ে ফেরির ইজারা বাতিল করে প্রশাসন। কিন্তু তারপরও ফেরিঘাটের জেটি ব্যবহার করে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড তুলে সাধারণ যাত্রী, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করে ইজারাদাররা। তারা জনপ্রতি যাত্রী ভাড়া ১০ টাকা এবং মোটরসাইকেল ভাড়া ৫০ টাকা আগেই আদায় করে নেয়। এতে করে ফেরিতে যাওয়া মোটরসাইকেল চালককে পুনরায় পৃথকভাবে ফেরি ভাড়া ১০ টাকা দিতে হয়। আবার ফেরিতে সাধারণ যাত্রীদের কোনো ভাড়া নেওয়া হয়না, ফলে তাদের থেকেও ইজারাদার আগেই ১০ টাকা আদায় করে নেন বলে অভিযোগ করেন অনেকেই। বিশেষ করে দূর থেকে আগত নতুন যাত্রী ও মোটরসাইকেল চালকরা এই হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
বাউফল গ্রাম থেকে আগত মোটরসাইকেলচালক ইমরান হাওলাদার বলেন, ফেরি যে এই ইজারাদারের আওতায় নয়, তা কি করে বুঝবো। ঘাটে আসতেই ওরা র্যারিকেড দিয়ে পথ আগলে ৫০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। আমি দেওয়ার পর ব্যারিকেড তুলেছে। পাশেই ট্রলারে অনেকে মোটরসাইকেল তুলছে দেখলাম। আমি সোজা ফেরিতে উঠেছি। কারণ ট্রলার আমার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। ফেরিতে ওঠার পর ভাড়া আদায়কারী ছুটে এসে বললেন, আপনিতো ওখানে ভাড়া দিয়ে এসেছেন, তাহলে ট্রলারে যান, নয়তো ভাড়া ফেরত নিয়ে নেন। শুনে ভাড়া ফেরত আনতে গেলে তারা ফেরত দেয়নি। বলে ট্রলারের যাত্রী কেন ফেরিতে উঠলেন?
এভাবেই একই জেটিতে ফেরি ও খেয়াঘাট থাকায় বারবার প্রতারিত এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। তাদের বেশিরভাগ এখন তাকিয়ে আছেন মাথার উপর নির্মাণাধীন গোমা সেতুর দিকে। গত ২৩ এপ্রিল থেকে এই সেতুর কাজ পুনরায় শুরু হয়েছে। মাথার উপর দিনরাত টুকটাক শব্দ চলছে। নিচে জেটিতে অপেক্ষা করছে বহুল প্রত্যাশিত দুটি স্পাম। এই স্পাম দুটোর জন্যই নির্ধারিত সময়ের চারবছর অপেক্ষা করতে হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষকে। আবারও কাজ শুরু হওয়ায় তাই মানুষের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস দেখা গেলো। এই কাজ যেন এবার শেষ হয় এবং সেতুটি যেন চালু হয় এজন্য রীতিমতো মসজিদে দোয়ার আয়োজন ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন চরাদি ইউনিয়নের মকিমাবাদ বাজারের ব্যবসায়ীরা। এই বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কবীর হাওলাদার বলেন, গোমা সেতুকে ঘীরে এই পথ যাতায়াত করা পটুয়াখালীর বাউফল, দশমিনা, ভোলার কয়েকটি চরাঞ্চলের মানুষ ছাড়াও বাকেরগঞ্জের কবাই, দুর্গাপাশা, ফরিদপুর অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি হবে। এটি আমাদের স্বপ্ন। এ পথে আরেকটি সেতু বা ফেরিঘাট প্রয়োজন হবে কারখানা নদীতে ডিসি রোড সংলগ্ন এলাকায়। তাহলেই দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষের সাথে বরিশালের যোগাযোগ সহজ হয়ে যাবে।
ব্যবসায়ী ফিরোজ খান বলেন, ২০১৮ সালে এই সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। সেতুর নকশায় গরমিল নিয়ে এখানে লঞ্চমালিক ও এলাকাবাসীর সাথে সেতু কর্তৃপক্ষের সমস্যা তৈরি হওয়ায় বেশ কয়েকবার কাজে বাঁধা পড়েছে। এরপর বেশ কয়েকবার কাজ ধরে আবার বন্ধ হয়। এদিকে এই সুযোগে খেয়াঘাটের ইজারার সাথে ফেরিও আটকে দেয় ইজারাদাররা। এতে আমাদের হয়রানি আর ভোগান্তি বেড়েছে।
এলাকাবাসীর পক্ষে সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ এর সদস্য সাইদুল ইসলাম বলেন, মূলত এই সেতু তৈরি হলে নিজ দিয়ে লঞ্চ চলাচলের সমস্যা হবে দাবী করে লঞ্চ মালিকদের পক্ষ থেকে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দেয়া হয়। যারফলে বিআইডব্লিউটিএ’র হস্তক্ষেপে দুটো স্পাম না বসিয়ে কাজ বন্ধ ছিলো। এখন আবার ঐ স্পাম দুটো বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। আশাকরি এবার এটি সমাপ্ত করে যানবাহন চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করবেন প্রশাসন। আমরা এজন্য গত কয়েক বছর ধরে অপেক্ষা করছি।
সেতুর ঠিকাদার এম মাহফুজ খান বলেন, নতুন করে দুটো স্পাম তৈরিতে পূর্বের বরাদ্দ থেকে দ্বিগুণের বেশি খরচ হয়েছে। যে কারণে এটি পুনরায় টেন্ডার হয়েছে। তাই কাজে বিলম্ব হয়েছে। নতুন টেন্ডারেও কাজটি আমাকেই করতে হচ্ছে। এতে আমার বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে গোমা সেতুর কাজ চলমান রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত কাজ এগিয়ে নিতে। কোরবানির আগে হয়তো যানবাহন চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করা সম্ভব হবেনা, তবে আগামী জুনের মধ্যেই এটিতে যানবাহন চলাচল শুরু করা যাবে। নতুন করে কাজ শুরু করতে বাজেট বৃদ্ধি করা হয়নি, পূর্বের বরাদ্দকৃত ১০০ কোটি টাকাতেই এ কাজ সম্পন্ন হচ্ছে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী।