
নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী সদর উপজেলার লাউকাঠি গ্রামে একটি মুরগির খোপ এখন শতবর্ষী লালবড়ু বেগমের একমাত্র আশ্রয়স্থল। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই বৃদ্ধা মায়ের জীবনের গল্প শুনলে যে কারো চোখে পানি চলে আসে।
একসময় নিজের কাঁধে দুই সন্তানকে মানুষ করেছিলেন যিনি, ভিক্ষা করে চালিয়েছেন সংসার, না খেয়ে থেকেছেন দিনের পর দিন, সেই মা আজ ঘরের ভেতরে ঠাঁই না পেয়ে ঘরের সামনের এক কোণে কাঠ-টিনের তৈরি একটি মুরগির খোপে কাটাচ্ছেন দিনরাত। আরেকটা নির্মম সত্য হলো, প্রতিদিন সকালে ঘরে তালা লাগিয়ে বাইরে চলে যান তার ছেলে ও ছেলের বউ।
লালবড়ু বেগমের স্বামী মারা যান দুই যুগ আগে। তখন থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামের জীবন। এক হাতে ভিক্ষা করে এবং অন্য হাতে সন্তান দুটিকে লালন করে বড় করেন তিনি। বড় ছেলে মোস্তফা ও ছোট ছেলে নাসির- দুজনেই আজ নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। লালবড়ু বড় ছেলে মোস্তফার সঙ্গে থাকেন। কিন্তু মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, সেই ঘরেও তার কোনো জায়গা নেই।
জানা যায়, ২০২২ সালে পটুয়াখালীর লোহালিয়া ও লাউকাঠি নদীর পাড়ে দখল করে গড়ে ওঠা অনেক অবৈধ ঘর উচ্ছেদ করে দেয় প্রশাসন। এরপর থেকে মোস্তফা তার পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেন নদীর পাড়ে অন্যের জমিতে। সেখানেই তৈরি করেন টিনশেড একটি অস্থায়ী ঘর, যেখানে প্রায়ই জোয়ারের পানিতে চারপাশ ভেসে যায়।
প্রতিদিন সকালে মোস্তফা অটোরিকশা চালাতে বের হন আর তার স্ত্রী রিনা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করতে যান।
তারা দু’জনেই ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে যান। ভেতরে নিরাপদ আশ্রয় তো নেই-ই, বরং বৃদ্ধা লালবড়ুকে ফেলে যান ঘরের সামনের উঠানে। একা চলতে না পারা লালবড়ুর চলাচল সীমিত। ঘরটা উঁচু, ভিতরে ঢুকতে পারেন না। ঘরের ভেতরের টয়লেটও তার নাগালের বাইরে। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটান মুরগির খোপে। সেখানে একটি পুরনো মাদুর, একটি ছেঁড়া কাঁথা আর কিছু কাপড়েই তার থাকার ব্যবস্থা। বর্ষার দিনে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ে ভেতরে, আবার গরমে দমবন্ধ হয়ে আসে।
কান্নাজড়িত কন্ঠে লালবড়ু বেগম বলেন, আমি সারাদিন এই খোপেই বসে থাকি, কখনো একটু ঘুমাইও। কিন্তু রাতে তো ঘুমানোই যায় না। সারা শরীর ব্যথা করে, গরমে দম বন্ধ হয়ে আসে। বড় ছেলে মোস্তফা কখনো কখনো খাওয়ার কিছু দিয়ে যায়, তখন খাই। তবে সবসময় দেয় না, তাই এলাকার এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে হাত পাততে হয়, ভিক্ষা করেই খেতে হয়।
তিনি আরও বলেন- কয়দিন আগে উঠানে পড়ে গেছিলাম, মাথায় ব্যথা পাইছি, হাত ভাঙছে- ডাক্তার দেখায়নি। দেহের যন্ত্রণা আর মনেও পোড়া লাগে। আল্লাহ যেন এমন জীবন কাওরে না দেয়।”
লালবড়ুর ছেলের বউ রিনা বেগম বলেন, ‘আমরা খুব কষ্টে আছি। একবেলা রান্না হইলে আরেকবেলা হয় না। সকালে কাজে যাই, সন্ধ্যায় ফিরি। শাশুড়ি একা চলতে পারেন না, ঘরটা উঁচু, ভিতরে উঠতে পারেন না। বাইরে খোপে থাকে, যাতে উনি সহজে বসে থাকতে পারেন। ভেতরে রাখলে ওনি টয়লেটে যাইতে পারেন না, কষ্ট হয়। তালা না দিয়া গেলে ঘরে জিনিসপত্র থাকে না, চুরি হয়। তাই বাধ্য হইয়া তালা দেই।’
লালবড়ুর নাতি শিপন খা বলেন, ‘আমার দাদি সারাদিন খোপে থাকেন। বিকেলে মা আসলে খাবার দেয়। অনেকদিন এমন গেছে, যখন মা কিছু আনতে পারেনি, দাদি না খেয়ে থেকেছেন। আমি কাজ করতাম সেখান থেকেও বাদ দিয়েছে, কিছু করতে পারি না। দাদির খুব কষ্ট হয় দেখি।’
স্থানীয় ইটভাটার ম্যানেজার মাসুদ হাওলাদার বলেন, ‘এই পরিবার সম্পূর্ণ ভূমিহীন। সরকার বা ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সহায়তা পায় না। লালবড়ু মা’র জন্য একটা নিরাপদ ঘর খুব দরকার। সমাজের যারা সামর্থ্যবান আছেন, তারা যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে হয়তো একজন মা তার শেষ জীবনটা শান্তিতে কাটাতে পারবেন।’