রবিউল ইসলাম রবি :: আ.লীগ শাসনামলের গত ১৫ বছরে দলীয় ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে এলাকার নিরীহ হিন্দু-মুসলমানদের জমি-বসতঘর দখলের পাশাপাশি স্কুল-কলেজে নিয়োগ বাণিজ্য ও লুটপাট সহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি পূর্বক শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার উত্তর শিয়ালকাঠী গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান মোঃ শহিদুল হক খান পান্না। ছাত্র জীবনে যুক্ত ছিলেন বিএনপির রাজনীতিতে। এরপর জাতীয় পার্টি। পরে ২০০৯ সালে আ.লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে পর্যায়ক্রমে হয়ে যান পিরোজপুর জেলা আ.লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, পিরোজপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পিরোজপুর জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌশলী (জিপি)। এ সব পদ অর্জনের সাথে সাথে পান্নার অর্থনৈতিকভাবে উন্নতিও ঘটে। সরেজমিনে উত্তর শিয়ালকাঠী গ্রামে যে কেউ পরিদর্শন করলে জনমুখে শোনা যাবে পান্নার ভয়ংকর অপরাধের তথ্য। গত ৫ আগষ্ট আ.লীগ সরকারের পতন হবার পর নির্যাতিতরা মুখ খুলতে শুরু করছে। অপরাধগুলোর রহস্য উন্মোচন করতে ‘অন্তবর্তীকালীন সরকারের সহযোগিতা’ চেয়েছেন নির্যাতিত গ্রামবাসী।
রাজনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম আউয়াল ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়া মহিউদ্দিন মহারাজের হাত ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্রুত উত্থান ঘটে পান্নার। আউয়ালের ছত্র-ছায়ায় ও তার সহযোগীতায় পিরোজপুর জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌশলী (জিপি) ও ভিপি কৌশলী হন। ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার করে দালালি, টেন্ডারবাজি ও অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মাত্র ১৫ বছরেই শত শত কোটি টাকা সহ বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে যান। অথচ- ২০০৯ সালের পূর্বে পান্নার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ছিল শোচনীয়। তার বাবা মোঃ ফজলুল হক খান নিজ চিকিৎসার জন্য সিহংভাগ জমি বিক্রি করে মারা যান। তখন ধার-দেনার ছিল তার পরিবার। আ.লীগ শাসনামলে পান্নার নানা অপরাধের তথ্য তুলে ধরে নির্যাতিতরা তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করলেও পাননি কোন প্রতিকার। জানা গেছে, এক মামলায় পিরোজপুরের সংসদ সদস্য এ কে আউয়ালের জামিন না মঞ্জুর করেন আদালত। সে সময় পিরোজপুরের বারের সম্পাদক মো. শহীদুল হক খান (পান্না) এজলাসে ভাঙচুরের উসকানি দেন। তখন থেকে আউয়ালের হৃদয় গহীনে পান্না।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে উত্তর শিয়ালকাঠী গ্রামের বাসিন্দা শহীদুল হক খান পান্নার বিরুদ্ধে গত ১৫ বছরে পাওয়া যায় প্রায় অর্ধশত ভয়ংকর অপরাধের তথ্যসহ সাক্ষাৎকার দিয়েছে ভুক্তভোগীরা। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল-
১. হিন্দু সম্প্রদায়ের মতিলাল মিস্ত্রী ও শেখর মিস্ত্রীর ভেষ্টেড সম্পত্তি ক্ষমতার অপব্যবহার করে পান্না তার ভাইয়ের নামে ডিসিআর কেটে জোর পূর্বক দখল করে নেয়। দুই দফায় মোট ২৯ শতাংশ জমি নেয়ার সত্যতা স্বীকার করেন বৃদ্ধ মতিলাল মিস্ত্রী ও ভাইয়ে ছেলে শেখর মিস্ত্রী।
২. ফারুক হাওলাদার ভাইদের অন্য বক্তির কাছে জমি বিক্রি করলে সেখানে কূটকৌশলে পান্না প্রতিপক্ষকে নিজের কব্জায় নেয়। দখল করে নেয় রাস্তার পাশে থাকা জমি। ফারুকের পরিবার বাঁধা দিলে দেয়া হয় চাঁদাবাজি মামলা। জোর পূর্বক দখল করে নেয় জমিসহ বসতবাড়ি। ফারুকের ছেলে আসিফ হাওলাদার বলেন, চাচার জমি বিক্রির টাকা আমরা দিয়ে বিক্রিত জমি ফেরত আনতে চাইলে পান্না এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেয়।
৩. ফিরোজ খান গংদের ১০ শতক ও এ্যাড. মাহাবুবুর রহমান খান এর ৫ শতক জমি শিয়ালকাঠী সুন্দর বন আদার্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভিতরে জোর পূর্বক দখল করে নেয়।
৪. আব্দুল হাই খান মাষ্টারের একশত বছরের পূর্বের ওয়ারিশদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে দলিল নিয়ে ইচ্ছেমত রাস্তার পার্শ্বের ভালো জমি জোর পূর্বক দখল করে নেয়।
৫. একইভাবে জামাল উদ্দিন খান গংদের ওয়ারিশদের কাছ থেকে দলিল নিয়ে ইচ্ছেমত ভালো জমি জোর পূর্বক দখল করে নেয়।
৬. দরিদ্র খলিল হাওলাদারের পুত্রবধু ও মেয়েরা গার্মেন্টেসে চাকুরী করে বসত বাড়ী নির্মাণ করার জন্য কয়েক শতক জমি ক্রয় করে। সেই জমিতে থাকা বসতঘর লুটপাট করে নিয়ে যায়। প্রতিবাদ করায় খলিলের সহ তার পরিবারের সকলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়। ৬ টি মামলায় এ পর্যন্ত ৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এখনও ২টি চলমান রয়েছে বলে জানান।
৭. মোঃ বেলায়েত হোসেন মাষ্টারের শিয়ালকাঠী সুন্দরবন আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন ৫০- ৬০ বছরের ভোগ দখলীয় জমি রাতের আধারে সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে ড্রেজার দিয়ে বালু ভরাট দিয়ে দখল করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে তিনি ৯৯৯ কল করলে পুলিশ আসে। তখন পুলিশ ও এলাকাবাসীর চাপে পরে পান্না দখল নিতে ব্যর্থ হয়। তিনি আরো বলেন, ২০০৯ সালের পূর্বে পান্নার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ছিল শোচনীয়। এখন শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন পান্না।
৮. ভিটাবাড়ীয়া যুবক সমিতি ও পাঠাগারের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য ভুয়া দলিল করে ভিটাবাড়ীয়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মরহুম আব্দুর রব হাওলাদারের পরিবারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মামলা দিলে তার ছেলে মোঃ মহিউদ্দিন পলাশ আইনি মারপ্যাচে জেলহাজতে যায়।
৯. হিন্দু নান্টু এদবরের জমি রেজিস্ট্রি করে নেয়ার হুমকি দেয়।
১০. দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ভিটাবাড়ীয়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জোর পূর্বক দীর্ঘ দিন পকেট কমিটি করে নিজে সভাপতি হইয়া শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। এবং বিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কাজের নামে সরকারি লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ এনে নামে মাত্র কাজ করে অর্থ আত্মসাৎ করে। এমনকি বিদ্যালয়ের ১৫ টি দোকান ঘর ভাড়া সিংহভাগ টাকা আত্মসাৎ করে।
১১. শিয়ালকাঠী সুন্দরবন আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দলীয় প্রভাব বিস্তার করেতার আপন চাচাতো ভাই আব্দুল খালেক খান ও আপন ভাই অশিক্ষিত মোঃ মইনুল হক খান কে সভাপতি করে শিক্ষক ও কর্মচারী পদে নিয়োগ বাণিজ্যতে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় এবং বিদ্যালয়ের উন্নয়ন মূলক কাজের নামে সরকারি লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ এনে কাজ না করাইয়া আত্মসাৎ করে। বিদ্যালয়ের এড়িয়ায় থাকা প্রায় ৩ লক্ষ টাকার গাছ ও একটি টিনসেট কাঠের ঘর (পুরাতন স্কুল) বিক্রি করে প্রায় দুই লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে। এ সব অপরাধ প্রতিরোধ না করতে পেরে স্কুল কমিটি থেকে ৪/৫ জন পদত্যাগ করে বলে জানান বেল্লাল হোসেন।
১২. শিয়ালকাঠী টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেন্স ম্যানেজমেন্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করে- শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানে সরকারি লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ এনে কাজ না করে আত্মসাৎ করে। কয়েক কর্মচারী দিয়ে কলেজে ও ফার্মে কাজ করানো হয়।
১৩. শিয়ালকাঠী আলিফ খান শিশু সদন এতিম খানা ও পার্শ্ববর্তী মসজিদে পাঠদানের নামে সরকারি লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ এনে আত্মসাৎ করে। ৫০ শিক্ষার্থীর স্থানে এতিম খানায় রয়েছে মাত্র ২০ জন। প্রতিষ্ঠান ২টি সম্পর্কে পান্না ছাড়া অন্য কারো কাছে কোন তথ্য থাকে না। কারণ- সভাপতি পান্না, সম্পাদক খোকন খান।
১৪. ১১ নং মধ্য শিয়ালকাঠী সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়টি ব্যক্তি কেন্দ্রিক করে ১৫ বছরের স্লিপ, রুটিন মেইনটেন্যান্স ও মেরামতের টাকা কাজ না করে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ করে। শিক্ষকরা তার কথা মত না চললে অন্যত্র বদলি করে দেয়। এ বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগের কথা বলে দুই জনার কাছ থেকে ৮ লক্ষ টাকা নিয়েছে।
১৫. সুইট বাংলাদেশ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করে প্রায় এক ডজন শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। অত্র বিদ্যালয়ে তেমন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী নেই বা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নেই। সরকারি বরাদ্দকৃত বেতন ভাতার টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে শিক্ষকদের সাথে আত্মসাৎ করে।
১৬. দলীয় প্রভাব প্রভাব বিস্তার করে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য হয়ে চাকুরী দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন লোকদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
১৭. জিপি এবং ভিপি আইনজীবী হওয়ার সুবাদে বহু বিচার প্রার্থীর কাছ থেকে অন্যায়ভাবে বিপুল পরিমান অর্থ হতিয়ে নেয়। নানা কার্যক্রমের নামে মন্ত্রণালয় থেকে আসা বিপুল পরিমান সরকারি বরাদ্দকৃত অর্থ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে। যা তদন্ত করলে বেড়িয়ে আসবে।
১৮. নিজ বসতবাড়ীর ভিতরে বাড়ীর লোকের বাঁধা উপেক্ষা করে এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের কোন অনুমতি না নিয়ে ক্ষমতার জোরে অবৈধভাবে ‘আর আর এগ্রো ফার্ম’ নামে বিশাল একটি পোল্টি ও ডেইরি ফার্ম চালু করেছে। যাতে পরিবেশ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গরুর ফার্মের বর্জ্যের দুর্গন্ধের কারণে বসবাসের জন্য অনুপযোগী ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে তার দাদার ভিটায়, একথা জানিয়েছেন তার আত্মীয়স্বজন। বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র ক্যামিস্ট গোলাম কিবরিয়া বলেন, তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১৯. পুকুরে মাছ চাষের প্রয়োজন দেখিয়ে খাল খনন করে দূর থেকে পানি আনার মাধ্যমে চাষের জমির ক্ষতি করেছেন মো. শহীদুল হক খান পান্না। এসব অনিয়ম দীর্ঘদিন চলে আসলেও আওয়ামী লীগের খুঁটির জোরে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতেন না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পিরোজপুর কোর্টের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, শহীদুল হক খান পান্না বড় ধরনের দুর্নীতিবাজ। তিনি রাজনীতিতে পল্টি দিয়ে নিজের ক্ষমতা মজবুত করেছেন বিগত দিনে। তার বিরুদ্ধে হিন্দুদের জমিদখল থেকে শুরু করে অর্থের বিনিময়ে স্কুলে শিক্ষক ও নৈশ প্রহরী নিয়োগ দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। স্কুল করার নামে অসহায় মানুষের জমি প্রশাসনিক আদেশে অধিগ্রহণ করিয়েছেন তিনি। তার পরিবারই এসব বিষয়ে এলাকার মানুষের কাছে বলে বেড়াচ্ছেন।
অভিযুক্ত মো. শহীদুল হক খান পান্না বলেন, আমার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন। হিন্দুদের সম্পতি নেয়ার তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। সবকিছু ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনার উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। আমি অন্যায় পূর্বক কোন কাজ করিনি। বরং এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে ভালো কাজ করেছি। কোন মানুষের ক্ষতি হোক এমন কাজ করিনি। পারলে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ কেউ উপস্থাপন করুক। আরো সম্প্রতি আমার বিরুদ্ধে ২টি মামলা হয়েছে।