
নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশালে ২৮৪ বছরের কালের সাক্ষী সাতানি জমিদার বাড়ি : অযত্নে ধ্বংসের পথে এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য
কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে জমিদারি প্রথা। হারিয়ে গেছে জমিদারদের প্রতাপ ও ক্ষমতা, তবে মুছে যায়নি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তেমনই এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের দত্তপাড়া গ্রামে অবস্থিত সাতানি জমিদার বাড়ি।
প্রায় ২২ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই জমিদার বাড়িতে রয়েছে মোট ২৪টি দালান। এর মধ্যে দুটি দালান নির্মিত হয়েছিল নবাব আলিবর্দি খানের শাসনামলে, ১৭৪১ সালে বর্গি আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে। ইতিহাসবিদদের মতে, এসব দালানের কাঠামো ও নকশা বিশ্লেষণে অনুমান করা যায়—সাতানি জমিদার বাড়িটির বয়স প্রায় ২৮৪ বছরেরও বেশি।
প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী ও নান্দনিক কারুকাজে সমৃদ্ধ এই জমিদার বাড়ি আজ অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ঝোপঝাড়ে ঘেরা, পরিত্যক্ত দালানগুলো স্থানীয়দের কাছে ‘ভূতের বাড়ি’ নামেও পরিচিত। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থী এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি দেখতে এলেও সংস্কারের অভাবে তারা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। অথচ যথাযথ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন হলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারত।
সন্ধ্যা নদীর তীরবর্তী স্থানে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি স্থানীয়ভাবে ‘সাতানি মন্দির বাড়ি’ বা ‘দত্তপাড়া জমিদার বাড়ি’ নামেও পরিচিত। ২৪টি দালানের মধ্যে কয়েকটি মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখানে নারায়ণ, মনসা ও দুর্গা মন্দির ছিল। বিশেষ করে একটি মন্দিরে একসঙ্গে তিনটি দুর্গাপূজার আয়োজন করা হতো—যা এ অঞ্চলের ধর্মীয় ইতিহাসে বিরল ঘটনা। তখন মহিষ বলিদানের প্রচলন থাকলেও পরবর্তীতে তা ভোগ প্রদানে রূপ নেয়। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যাত্রা, থিয়েটারসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।
বর্তমানেও সাতানির পার্শ্ববর্তী মন্দিরে ঐতিহ্যবাহী ১০ হাত লম্বা কালীমাতার কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়, যা স্থানীয় সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার সাক্ষ্য বহন করছে।
জমিদার বাড়িতে প্রবেশপথেই দৃষ্টি কাড়ে একটি সহমরণ সমাধিক্ষেত্র, যা ভারতবর্ষে প্রচলিত সতীদাহ প্রথার নির্মম ইতিহাসের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সূত্রমতে জানা যায়, একসময় সাতানিতে একটি পঞ্চম শ্রেণির বিদ্যালয় ছিল, যেখানে ইন্দির আইচের মতো নামকরা পণ্ডিত দায়িত্ব পালন করেছেন। নিমাচাঁদ চক্রবর্তী ছিলেন শিক্ষক। ধর্ম খানের বংশধর মতিলাল ভৌমিক বাইশারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন। ভীম ভৌমিক ছিলেন ভারতবর্ষের বিখ্যাত খোলবাদক। তাঁর উত্তরসূরি ডা. লক্ষীকান্ত ভৌমিক ও ডা. সূর্যকান্ত সাহা মানবসেবায় সুনাম অর্জন করেন। ডা. সূর্যকান্ত সাহার ছেলে ডা. উত্তম কুমার সাহা বর্তমানে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
ডা. উত্তম কুমার সাহা জানান, বহু বছর আগে জমিদার বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। অভিযোগ করে তিনি বলেন, স্থানীয় এক ব্যক্তি লিজ নিয়ে ঐতিহ্যবাহী গাছপালা কেটে ফেলেছেন। এছাড়া তাঁর কাকা শহীদ সৈনিক আদিত্য সাহার সমাধি মন্দির বেদখলের কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে। তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান—অর্পিত বা দখলকৃত সম্পত্তি যেন মূল মালিকদের কাছে প্রত্যর্পণ করা হয়, অথবা লিজ প্রদান করা হলে তা যেন উত্তরাধিকারীদের কাছেই দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় সার্বজনীন মন্দিরের সভাপতি দেবাশীষ দাস বলেন, “বানারীপাড়ার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির পেছনে এসব ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষায় উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে এসব স্থাপনার সংযোগ বজায় রাখা জরুরি।”
স্থানীয় বাসিন্দা, বরিশাল বেতারের ঘোষক ও প্রাবন্ধিক বিশ্বনাথ রায় বলেন, “দত্তপাড়া সাতানি জমিদার বাড়ি একটি অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ। একসময় ঘণবসতিপূর্ণ এই এলাকা আজ নীরব ও পরিত্যক্ত। দালানগুলোতে এখন চামচিকা, সাপ, বেজি, কাঠবিড়ালি ও লতাগুল্মের বসতি। দ্রুত সংরক্ষণ উদ্যোগ না নিলে এই ইতিহাস চিরতরে হারিয়ে যাবে।”


