ঢাকারবিবার , ২৬ মে ২০২৪

যার আমানতদারি নেই, তার ঈমান নেই

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
মে ২৬, ২০২৪ ৯:১৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

মুহাম্মদ নাসীর উদ্দিন :: যার আমানতদারি নেই, তার ঈমান নেই।

রসূলুল্লাহ স. বলেছেন- ‘যার আমানতদারি নেই, তার ঈমান নেই। যার প্রতিশ্রুতির ঠিক নেই তার দ্বীন নেই।’ মুসনাদে আহমাদ, ১২৩৮৩

মুসলিম শরীফে বর্নিত হয়েছে, যার উপার্জন হারাম, আল্লাহ পাক তার দু’আ কবুল করেন না।

অন্য এক হাদীসে রাসুল (স.) ঘোষণা দিয়েছেন,
لَا تُقْبَلُ صَلَاةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ وَلَا صَدَقَةٌ مِنْ غُلُولٍ.
ওযু ছাড়া নামায কবুল হয় না, আর আত্মসাতের (অর্থাৎ অবৈধভাবে উপার্জিত) সম্পদের ছদকাও কবুল হয় না। (সহীহ মুসলিম)

ব্যবসায়-বাণিজ্যে ইসলাম সুনির্দিষ্ট কিছু নীতি মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে। আর্থিক লেনদেনে সততা, স্বচ্ছতা, অঙ্গীকার পূরণ করা, যথাযথ যাকাত দেয়া ইত্যাদি। উন্নত গ্রাহকসেবা প্রদান করার ব্যাপারে ইসলামী শরিয়া সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলাম ব্যবসায় ধোঁকা, প্রতারণা, মজুতদারি, ভালো মালের সাথে মন্দ মাল মিশিয়ে বিক্রি করা, ওজনে কম দেয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদি বিষয়কে কঠোরভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। ফটকাবাজি, সুদ, জুয়া, গোষ্ঠী বিশেষের বাজার নিয়ন্ত্রণ, একচেটিয়া কারবার, পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করা, মিথ্যা শপথ করা ইত্যাদি নেতিবাচক কাজকেও ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য একটি মহৎ পেশা। সততা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালিত হলে সেখানে অন্যায়-অনিয়ম স্হান পেতে পারে না। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবেন। কুরআন ও সুন্নাহতে ওজনে কম দেওয়াকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, নিন্দনীয় ও পরকালীন দুর্ভোগের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য ধ্বংস।

এরা লোকের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় মেপে নেয় এবং যখন অন্যদের মেপে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে তারা ( চুড়ান্ত বিচার ফায়সালার) দিন পুনরুত্থিত হবে সেই মহাদিবসে? যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে। ( সুরা মুতাফফিফিন-১-৬)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যখন মেপে দেবে পূর্ণ ওজন করে দিবে এবং ওজন করবে সমান-সঠিক দাঁড়িপাল্লায়, এটাই উত্তম এবং পরিণামের দিক থেকে কল্যাণকর। (সুরা বনি ইসরাঈল- ৩৫)

ইসলামে মজুদদারি নিষিদ্ধ। ইসলামে বাজারব্যবস্থা উন্মুক্ত, অবারিত এবং তা চাহিদা ও জোগান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু কোনো অসৎ ব্যবসায়ী যদি মজুদদারিতে লিপ্ত হয় এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, তাহলে এটি বাজারমূল্য প্রভাবিত করে। এতে গ্রাহকের সমস্যা তৈরি হয় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ক্রেতা জুলুমের শিকার হয়। একটি ইনসাফপূর্ণ বাজারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাই ইসলাম মজুদদারি, মালামাল বাজার থেকে তুলে নিয়ে দাম বাড়ানো এবং অধিক মুনাফার প্রত্যাশা করাকে অবৈধ করেছে। কেননা মজুদদারি, পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং অনেক মানুষ দুর্ভোগ ও অশান্তিতে পতিত হয়। এ ধরনের কাজ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়ে দেয়। তাই ইসলাম এ ধরনের কাজকে হারাম ঘোষণা করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যবসায়ী পণ্য আবদ্ধ ও স্তূপ করে সে গুনাহগার। (সহিহ মুসলিম-১৬০৫)

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য গুদামজাত করে সে পাপী। (সহিহ মুসলিম-৪২০৭)

যারা পণ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশায় তাদের ভাবা উচিত, দুনিয়ায় মানুষকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও মহান আল্লাহকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না।

পণ্যের দোষত্রুটি গোপন রাখা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কোনো ব্যবসায়ীর জন্য উচিত নয় কোনো জিনিস বিক্রি করা এবং তার ভেতরের দোষত্রুটির কথা বর্ণনা না করা। (মুসনাদে আহমাদ-১৭, ৪৫১)

রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার একজন শস্য ব্যবসায়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময় তিনি তার শস্যের স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তখন ভেতরের শস্যগুলোতে তিনি কিছু আর্দ্রতা অনুভব করলেন। আল্লাহর রাসুল জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? ওই ব্যবসায়ী জবাব দিলেন, বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ভেজা অংশটা ওপরে রাখলে না কেন? তারপর আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, ‘যারা আমাদের ধোঁকা দেয় তারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (সহিহ মুসলিম- ১০২)

সুদ বা রিবাকে নিষিদ্ধ করে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ করেছেন, আর সুদকে করেছেন নিষিদ্ধ। ’ (সুরা আল-বাকারা- ২৭৫)

ধরুন, জনৈক ব্যক্তি ‘মালকাচা’ দিয়ে মাথায় টুপি ঠেসে দিয়েছেন। তিনি ফরজ তরক করলেও তথাকথিত সুন্নতের খেলাপ করেন নি। তিনি সুন্নতের সাঙ্ঘাতিক পাবন্দ। আবার নিয়মিত টুপি, লম্বা পাঞ্জাবি, লম্বা দাড়ি, তথাকথিত হাফেজ কিংবা মাওলানা সাহেব। দির্ঘদিনের সুদের কারবারি ও সুপারি বিক্রেতা। তিনি যখন ক্রেতার কাছ থেকে ক্রয় করেন তখন ওজনে বেশি নেন কিন্তু বিক্রি করার সময় আড়তদারকে কম দেন। আড়তদার টুপি, লম্বা দাড়ি, লম্বা জুব্বা, তথাকথিত হাফেজ, মাওলানা হওয়ার কারনে দির্ঘদিন যাবৎ বিশ্বাস করে তাঁর মাল না মেপে বস্তা হিসেব করে আড়তে রেখে দিলেন। এভাবে বিশ্বাসের মোজেজা চলতে থাকলো বহুবছর। একদিন বেরসিক লেবার সবার বস্তার সাথে না বুঝে, ওনার বস্তাও একে একে মেপে ফেললো। দেখা হলো সকল বস্তায় মাল কম। আড়তদার বিশ্বাস করে ভুল করেছিলেন আর মুন্সি সাহেব আড়তদারের বিশ্বাসের সাথে নিয়মিত প্রতারনা করেছেন। লেবার ঘটনা খুলে বলার পর আড়তদার বললেন ‘মুন্সি সাহেব’ আপনাকে এতো বিশ্বাস করতাম আর আপনি এসব করছেন? কত বছর যাবৎ এ প্রতারনা করছেন? অনুনয় বিনয় করে ‘মুন্সী সাহেব’ ক্ষমা চেয়ে জরিমানা দিয়ে রেহাই পেলেন। চোরের দশদিন গেরস্তের একদিন। হয়ত আড়তদারের আদালতে ক্ষমা ভিক্ষা পেলেন কিন্তু টুপি,লম্বা পাঞ্জাবি, লম্বা দাঁড়ির কি হাল করলেন? আড়তদারের কাছে রেহাই পেলেও আল্লাহর দরবারে কি রেহাই পাবেন?

মহান আল্লাহ হেদায়েত দান করুন। এসব লেবাসধারী প্রতারক, ঠকবাজদের হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দিন। আমাদেরকে আপনার পছন্দের বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমাদের সকল ভুল ক্ষমা করুন। জাতিকে এসব ধান্ধাবাজ, ঠকবাজদের হাত থেকে রক্ষা করুন।

কলাম লেখক ( বিশিষ্ট সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী)
মুহাম্মদ নাসীর উদ্দিন
——————————