
নিজস্ব প্রতিবেদক :: কোটা সংস্কার আন্দোলনে অর্ধ শতাধিক সাংবাদিক হতাহত হয়েছে : বিএমএসএফ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঢাকায় মেহেদী হাসান হামলায় ও সিলেটে এটিএম তুরাব নামে গুলিবিদ্ধ দুই সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া প্রায় অর্ধ শতাধিক সাংবাদিক পুলিশ, ছাত্রলীগ, কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মী ও ছাত্র দল-শিবির ক্যাডার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অগনিত সাংবাদিক লাঞ্ছিত, হয়রানি ও ক্যামেরা ভাঙ্চুরের শিকার হয়েছে। তবে পুলিশ দ্বারা সাংবাদিকরা নিরাপত্তার বিপরীতে গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়েছেন; যা অনভিপ্রেত এবং উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম-বিএমএসএফ ও সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি, বাংলাদেশের প্রাপ্ত তথ্যে শুরু থেকে চলমান আন্দোলনের ছবি, খবর ও ভিডিও সংগ্রহ করতে গিয়ে এমন হামলার শিকার হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় মিডিয়া বিটিভি অফিসেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
দুই সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনায় বিএমএসএফ’র পক্ষ থেকে গভীর শোক, সমবেদনা জানানো হয়েছে। নিহত ও আহতদের ব্যাপারে নিন্দা-প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের বিচারের আওতায় আনাসহ নিহতদের পরিবারের খোঁজ খবর নিয়ে ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ ও আহত সাংবাদিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি অবিলম্বে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে সরকারের প্রতি বিশেষ ভাবে আহবান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম বিএমএসএফ ও সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি, বাংলাদেশের প্রাপ্ত তথ্যে জানাগেছে, খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকার কাজলায় কোটা বিরোধী আন্দোলনের হামলায় আহত হন মেহেদী হাসান। তিনি হামলায় আহত হলে মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। মেহেদী ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক ছিলেন বলে জানাগেছে। এদিকে সিলেটে এটিএম তুরাব নামে ফটোসাংবাদিক পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় মারা গেছেন।
যশোরে কোটা সংস্কারকারীদের হামলায় যুগান্তরের ফটো সাংবাদিক হাসফিকুর রহমান পরাগ আহত হন। শুক্রবার যাত্রাবাড়িতে আরটিভির রায়হান, দৈনিক মাতৃভূমির খবরের এক নারী সাংবাদিককে কোটা বিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের দ্বারা হামলা ও লাঞ্ছনার শিকার হন। নিহত মেহেদী হাসানের সাথে থাকা মারিয়া আক্তার নামে এক নারী সাংবাদিক আহত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। মিরপুরে সাপ্তাহিক বার্তা বিচিত্রার সম্পাদক তুহিন ভুঁইয়া গত শুক্রবার দুপুরের দিকে পুলিশের গুলিতে আহত হন এতে তার একটি কান ছিড়ে যায়।
এদিকে গত বৃহস্পতিবারে কোটা বিরোধী আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার ভাস্কর ভাদুড়ি আহত হয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সংগ্রহকালে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন নিউজ টুয়েন্টিফোরের সাভারের প্রতিনিধি নাজমুল হুদা আহত হন তার ক্যামেরাপারসন এমদাদ হোসেন এবং প্রথম আলোর জাবি প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মামুন। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় সাংবাদিক মাজাহারুল রিফাতের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়ে তাকে আহত করে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে দৈনিক ত্রিনদীর প্রতিনিধি বুলবুল ইটপাটকেল নিক্ষেপে মাথা ফেটে আহত হন।
যাত্রাবাড়িতে ৭১ টিভির সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন আাহত হয়েছেন। এসময় তার ক্যামেরাপার্সন রাশেদও আহত হন। রামপুরা এলাকায় কাঁদানো গ্যাসের যন্ত্রণায় এশিয়ান টিভির রিপোর্টার শফিকুল ইসলাম আহত হন। রামপুরায় পুলিশের গুলিতে আহত হন জীবন আহমেদ নামে এক সাংবাদিক। গুলিতে আরেকজন আহত হয়েছেন জাগো নিউজের নারায়নগঞ্জ প্রতিনিধি মুবাশ্বির শ্রাবণ। একদল সন্ত্রাসী নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবেও হামলা চালায়। মিরপুর এলাকায় বাংলাভিশনের স্টাফ রিপোর্টার মামুন আব্দুল্লাহ ও ক্যামেরাম্যান লিটন খান গুরুতর আহত হন। রামপুরা বনশ্রী এলাকায় আন্দোলনকারীদের হামলায় গ্রিন টিভির প্রধান প্রতিবেদক এম এম সেকান্দার, বিশেষ প্রতিনিধি সাইফুল রুদ্র, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মিজানুর রহমান, প্রতিবেদক অজিত সরকার, ক্যামেরাম্যান মঞ্জিল মিয়া ও গাড়ির ড্রাইভার আতিক আহত হন। এ সময় তাদের ক্যামেরার কার্ড ও গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন।
রাজধানীর শনিরআখড়া কাজলায় সাংবাদিক শেখ মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহর ৪তলা বাসায় পুলিশের টিয়ারসেল ঢুকে তিনি আহত হন। উত্তরায় একটি অনলাইন মিডিয়ার সংবাদকর্মী এবং সিলেটে এশিয়ান টিভির রিপোর্টার পিংকু দাস আহত হন। এ সময় তিনি তার ক্যামেরা ও গাড়ি ভাঙচুরের দাবি করে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। এদিকে আরটিভি ও আনন্দ টিভির দুই সাংবাদিককে মারধর এবং মানবকন্ঠের লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান সাজুর মিডিয়া অফিসে হামলা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করে হাতিবান্ধায় সাংবাদিক নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন বাচ্চু। এদিকে আ’লীগের অফিস ভাংচুরের কথিত অভিযোগে মানবকন্ঠের প্রতিনিধি ও বিএমএসএফ’র জেলা সম্পাদক আসাদুজ্জামান সাজুসহ বিএনপির লোকজনকে আসামি করে হাতিবান্ধা থানায় মামলা দায়ের করে।
পুলিশের টিয়ারশেল-সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে বুধবার আহত হন দৈনিক কালবেলার লিড মোজো আকরাম হোসাইন। একই স্থানে সাউন্ড গ্রেনেডে আরো কয়েকজন সংবাদকর্মী আহত হয়েছেন। আহত অপরাপর সাংবাদিক এসএ টিভির রিপোর্টার রহমত উল্যাহ, দৈনিক জনবানীর তুষার এবং বিজনেস বাংলাদেশ পত্রিকার আরসালান সহ আরও অনেকে। পাবনায় এটিএন নিউজের প্রতিনিধি বিজলী জয় আহত হয়েছেন।
ঘটনা এবং পরিস্থিতির কারণে আহত অনেক সাংবাদিকই দিক্বিদিক ছুটে চিকিৎসা নিতে কেউবা হাসপাতালে আবার কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে গেছেন। বুধবার সন্ধ্যায় অনলাইন ভিত্তিক রূপান্তর টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন মোহাম্মদ হাবিব ও সিনিয়র ক্যামেরাপার্সন মোহাম্মদ জাহিদুল আলম জাহিদ যাত্রাবাড়ী থানার সামনে কোটা সংস্কারের সংবাদ সংগ্রহের সময় আহত হন।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়ে বরিশালের নথুল্লাবাদে যুগান্তরের শামিম আহমেদ, ডিবিসির সাব্বির আহমেদ, বিএমএসএফ’র মহানগর শাখার সম্পাদক ও নয়া শতাব্দী ব্যুরো রাইসুল ইসলাম অভি, BHS News এর সিদ্দিকুর রহমানসহ সংবাদকর্মীদের উপর হামলা করেছে শিক্ষার্থীরা, ভেঙে ফেলা হয়েছে ক্যামেরা। এসএ টিভির সংবাদ উপস্থাপক ও রিপোর্টার রিফাত শিশির ঢাবি ক্যাম্পাসে আহত হয়েছেন। সরেজমিন পত্রিকার রিপোর্টার রিপন হাওলাদার বৃহস্পতিবার মহাখালীতে পুলিশের গুলিতে আহত হন। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে তিনটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
শনিবার ২০ জুলাই আন্দোলনের খবর সংগ্রহে গিয়ে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার শাহরিয়ার অনির্বান ও মাহমুদুল হাসান পারভেজ আহত হন। একই দিন বিএমএসএফ’র সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান রাজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। রাজধানীর বনশ্রী মেরাদিয়া এলাকায় শিবিরের ক্যাডাররা এশিয়ান টিভির রিপোটর্টার উজ্জ্বল ভুঁইয়াকে আটকিয়ে তার প্রাইভেট কার ভাংচুর এবং আগুন দিতে উদ্যত হলে কান্নাকাটি করে পায়ে ধরে রক্ষা পান।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিবৃতিতে বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আহমেদ আবু জাফর বলেন, কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে আমাদের দুই সাংবাদিক মারা গেছেন। অর্ধ শতাধিক আহত এবং অগনিত সাংবাদিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। আহত অনেক সাংবাদিক লোকলজ্জার ভয়ে চুপসে গেছেন। আমরা অভিযোগ পেয়েছি সাংবাদিক পরিচয় জেনে শুনেও পুলিশ হামলা কিংবা টিয়ার সেল এবং কোথাও গুলি করে আক্রান্ত করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনাই চরম নিন্দনীয়। আমরা এ সকল সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় সরকারের কাছে বিচার, ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের দাবি করছি। একই সাথে জাতীয় সংসদে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়; অন্যথায় সেপ্টেম্বরের পরে দেশব্যাপী কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।


 

 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
								                                                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    