নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে বালু উত্তোলনের মহোৎসব মাসে ওঠে লাখ লাখ টাকা চাঁদা, প্রশাসন নিরব।
রাতের আধারে নগরীর কীর্তনখোলা নদীর একাধিক স্থান থেকে চলছে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। কমপক্ষে ৫ টি লোড ড্রেজার (১২ ইঞ্চি) দিয়ে দপদপিয়া ব্রীজ সংলগ্ন এলাকা, কালিজিরা প্রান কোম্পানি এবং অপসোনিন ফার্মা এলাকার নদীতে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই লক্ষাধিক সিএফটি বালু তুলে তা প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়। পূর্বে আওয়ামী লীগের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু নেতাকর্মী, আমিরাবাদের শাহীন চেয়ারম্যান এবং থানা পুলিশের যোগসাজশে নলছিটির সীমানায় ড্রেজারগুলো দিয়ে বালু উত্তোলন করা হতো। কিন্তু দেশের পট পরিবর্তনের পর এখন পুরো প্রক্রিয়াটির নিয়ন্ত্রন নিয়েছে ২৪, ২৫ এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ড এবং নলছিটি উপজেলার কতিপয় বিএনপির নেতাকর্র্মী। গত ২-৩ মাস ধরে প্রকাশ্যে চলছে বালু উত্তোলন। এজন্য প্রতিদিন ড্রেজার প্রতি তোলা হচ্ছে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। পূর্বে আমিরাবাদ, মগর এলাকায় এই ড্রেজারগুলো দিয়ে বালু উত্তেলন করায় নদী ভাঙনের শিকার হতেন স্থানীয়রা। এজন্য একাধিকবার ড্রেজারগুলো আটক করে স্থানীয়রা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করে। ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানও পরিচালিত হয়। এতকিছুর পরেও প্রতিকার মিলছে না। এভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে নদীর উভয় পাড়ে ব্যাপক ভাঙন দেখা দেবে যা স্থানীয়দের জন্য বড় ধরণের হুমকী। নৌ-পুলিশের ওসি ও উর্ধতন কর্মকর্তা, সদর থানা সহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে বালু উত্তোলন হওয়ায় প্রশাসনকে জানিয়েও কোন কাজ হচ্ছেনা বলে অভিযোগ নদী পাড়ের বাসিন্দাদের। নগরীর ২৪ নং ওয়ার্ডের এক বিএনপি নেতা সহ বেশ কিছু প্রভাবশালীদের সাজানো এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে চাইলেও স্থানীয়রা কিছুই করতে পারছে না।
বর্তমানে নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রান কোম্পানী ও অপসোনিন ফার্মা এলাকার নদীতে প্রতিদিন রাত ৮ টা থেকে ৯ টার মধ্যেই বালু উত্তোলন করে মোট ৫ টি লোড ড্রেজার। যা চলে ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত। এসকল ড্রেজারের মালিকরা হলেন : কালিজিরা পাথর খোলা এলাকার লিটন খান, দপদপিয়া এলাকার রুবেল, সাইফুল ও সিফাত, কালিজিরার ছোট রুম্মান এবং শুভ। এদের মধ্যে কেউ মালিক কেউ আবার ভাড়া ড্রেজার পরিচালনা করে। প্রতিটি ড্রেজার ১২ ইঞ্চি তথা বড় মাপের। এরা ড্রেজার প্রতি প্রতিদিন ৩-৫ হাজার টাকা চাঁদা দেয় ২৪, ২৫ এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ড এবং নলছিটি এলাকার বিএনপি নেতাদের। চাঁদার টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছে প্রত্যেক ওয়ার্ডের নির্ধারিত বিএনপির কর্মিরা। এদের মধ্যে কেউ কেউ বালু বিক্রির সাথেও জড়িত। অনুসন্ধানে চাঁদা উত্তোলনের কাজে নিয়োজিতদের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলো : ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা বাছের মৃধা, মাসুদ খান, শেখ সাদি, কামরুল খান ও রিপন। এদের নেতৃত্ব দেন বাছের মৃধা। তিনি চাঁদা তোলা এবং ওই এলাকায় চোরাই তেলের সিন্ডিকেটও পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগ আমলে নেতাদের ম্যানেজ করে অবৈধ উপায়ে জ্বালানি তেল বিক্রির সিন্ডিকেট শুরু করে বাছের। পার্শবর্তী নৌ-বাহিনী ক্যাম্পের কাছে নোঙর করা জাহাজ থেকে কৌশলে চুরি করে আনা তেল বিক্রির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২৫ এবং ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে চাঁদা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন রাকিব এবং মহানগর ছাত্রদল নেতা আসাদ। নদীর ঠিক অপর পাড়ের প্রতিনিধি হিসেবে টাকা তোলেন নলছিটি ভাঙ্গা দৌলা এলাকার শিমুল ও মঈন। ৫টি ড্রেজার থেকে প্রতিদিন ১৫-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত তোলে এরা। এই টাকা ভাগ হয় ওয়ার্ড ভিত্তিকভাবে। ৫ আগস্ট আাওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ২৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সর্বপ্রথম দপদপিয়া ব্রিজ এলাকায় বালু উত্তোলন করানো শুরু হয়। বিএনপির এক নেতা তিনি প্রধান হিসেবে থেকে ২৫ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির লোকজন নিয়ে তৈরি করেন এই সিন্ডিকেট। উত্তোলিত এই চাঁদার টাকা শুধু নেতাদের জন্য। নৌ-পুলিশ, স্থানীয় থানার ভাগ ড্রেজার পরিচালনাকারীরা উত্তোলন করেন নিজেদের মধ্য থেকে। পূর্বে নলছিটি থানায় মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা এবং নৌ-পুলিশকে দিতে হতো একই পরিমানের অর্থ। টাকা দিলে নির্বিঘেœ চলতে দেয়া হয় ড্রেজারগুলো। কোন অভিযান হলেও তার খবর পৌঁছে যায় আগেভাগে। বর্তমানে দিনের বেলায় সব লোড ড্রেজারগুলো কালিজিরা খাল এর মাথায় ডকে রাখা থাকে। রাত হলেই এরা নেমে পড়ে বালু উত্তোলনে। আর চলে সারারাত। প্রতিদিন একটি ড্রেজার ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার সিএফটি বালু উত্তোলন করে। কালিজিরা এলাকার বাসিন্দা বরিশাল জেলা জজের গাড়ি চালক পরিচয় দেয়া হোসেন, সাবেক কমিশনার হুমায়ন কবিরের খালাতো ভাই পলাশ হাওলাদার, সাইফুল, লিটন খান, দপদপিয়ার রুবেল তাদের মালিকানাধীন বিভিন্ন মাপের বাল্ক হেডের মাধ্যমে এই বালু নগরীসহ আশেপাশের এলাকায় জমি ভরাটের জন্য বিক্রি করেন। ড্রেজারের শক্তিশালী ইঞ্জিনের শব্দে বসতবাড়িতে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতেও পারেন না। এ বিষয়ে সদর থানা নৌ-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সনাতন সরকার বলেন, তিনি সদ্য এই থানায় এসেছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সঠিক নয়। পূর্বে কেউ এ বিষয়ে জড়িত ছিল কিনা তা জানা নেই। তবে বর্তমানে তারা নদীর এমন লুট কোনভাবেই মানবেন না। সঠিক তথ্য পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জড়িতদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও জানান তিনি।
বরিশাল সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজাহারুল ইসলাম বলেন, অবৈধভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের এই লুট কোনভাবেই মানবেন না। বালু উত্তোলনের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। তথ্য পেলে তাৎক্ষনিক অভিযান পরিচালনার কথাও জানান তিনি।