নিজস্ব প্রতিবেদক :: ডিসেম্বরে হস্তান্তরের কথা থাকলেও ২০০ কোটি টাকার গোমা ও নেহালগঞ্জ সেতুর ভবিষ্যত অনিশ্চিত !
ডিসেম্বরে গোমা সেতু হস্তান্তরের কথা থাকলেও এখনো বসেনি স্পাম, সমাপ্ত হয়নি কাজ। একই অবস্থা নেহালগঞ্জ সেতুটিরও। গত চার বছরে চারবার পরিবর্তন হয়েছে হস্তান্তরের মেয়াদ। সর্বশেষ গেল ডিসেম্বরে কাজটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সমাপ্ত হয়নি বরিশালের রাঙ্গামাটি ও আড়িয়াল খাঁ নদীর উপর নির্মাণাধীন দুটি সেতুর কাজ। এর একটিতে দুটি স্পাম বসানোর কাজ বাকী। অন্যটিতে একটি স্পাম ও দুপাশের সংযোগ সড়কের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতায় আটকে আছে সেতু নির্মাণ কাজ। দুটি সেতুরই দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ একই। দৈর্ঘ্য ৮০০ মিটার। নির্মাণ ব্যয় ১০০ কোটি টাকা করে দুটোর ২০০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যেকোনো সময় শেষ হবে গোমা সেতুর কাজ। আর চলতি বছরের এপ্রিল বা মে মাসে শেষ হবে নেহালগঞ্জ সেতুর নির্মাণ। যদিও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
সরেজমিনে গত ১ জানুয়ারি দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বরিশাল বাউফল, ভোলা, লক্ষ্মিপাশা ও দুমকি মহাসড়কের সংযোগে প্রথমে আড়িয়াল খাঁ নদীর উপরে নির্মিতব্য নেহালগঞ্জ সেতুটি এবং দুপুরের পরে বাকেরগঞ্জের চরাদি ও দুধল ইউনিয়ন নিয়ে বয়ে চলা রাঙামাটি নদীর উপরে গোমা সেতু ঘুরে দেখে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে এর ভবিষ্যত যে অনিশ্চিত তা স্পষ্ট বোঝা গেছে। নেহালগঞ্জসেতুর মাত্র একটি স্পাম বসাতে এতোটা সময় লাগার কথা নয় বলে দাবী সাধারণ মানুষের। এখানে জমি অধিগ্রহণ জটিলতা এখনো কাটেনি বলে জানালেন বরিশাল সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের পতাং গ্রামবাসী। আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপারে চন্দ্রমোহন ইউনিয়ন। দুটি ইউনিয়নের সংযোগ সৃষ্টি হলে ভোলা, বাউফল ও পটুয়াখালীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থার কিছুটা অগ্রগতি হবে এখানে। তবে ভোলার সাথে সংযোগের জন্য আরো দুটো সেতু নির্মাণ করতে হবে বলে জানান এলাকাবাসী।
অন্যদিকে গোমা সেতুর উপর দিয়েও বাউফল, পটুয়াখালী, বরগুনা যাতায়াত সহজ হবে। এরফলে চরাঞ্চলের কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের বরিশালে যাতায়াত সবচেয়ে সহজ হবে বলে জানালেন গোমা বাজারের ব্যবসায়ীরা। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুটি সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিলো ২০১৮ সালে। সরকারি অর্থায়নে তিন বছর মেয়াদের প্রকল্প দুটি অনুমোদন পেয়েছিল ২০১৭ সালে। তখন প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৫৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধিত প্রাক্কলনে এর ব্যয় বেড়ে নির্ধারণ হয়েছে ৯২ কোটি ৫৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা। পরবর্তীতে কাজ শুরু হওয়ার পর উচ্চতা জনিত সমস্যায় মামলা ও তার সংশোধন নিয়ে নিষ্পত্তি জটিলতায় ৯ মাস বন্ধ ছিলো দুটি সেতু নির্মাণের কাজ। ২০২৩ সালে পুনরায় কাজ শুরু হয় এবং গত জুনে এই কাজ হস্তান্তরের কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত দুটি ব্রীজের একটিও হস্তান্তর হয়নি। এ নিয়ে স্থানীয় উপকারভোগী প্রায় লাখ মানুষের ক্ষোভ দিনকে দিন বাড়ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশীয় তহবিলে ২ হাজার ৫৪০ ফুট দীর্ঘ এই সেতুর কাজ বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। গোমা অংশে সেতুটির ১ হাজার ফুট সংযোগ সড়কের মাটির কাজ ছাড়াও নদীর মধ্যবর্তী অংশে সেতুর স্প্যানের দুই পাশের প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিট গার্ডার‘র নির্মান কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। নকশা সংশোধন করে মধ্যবর্তী অংশে স্টীল টাইপ স্ট্রাকচারের জন্য দরপত্র আহবান করেছে সড়ক ও জনপথ বরিশাল সার্কেল। সেতুটির ১৩টি স্প্যানের ১২টি পিয়ার ছাড়াও দুটি এবাটমেন্ট‘র নির্মান কাজ প্রায় শেষ পর্যায় হলেও নদীর মধ্যবর্তী অংশের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে নকশা সংশোধন করে ইস্পাতের অবকাঠমো নির্মাণ করতে হচ্ছে। এই সেতুর নির্মান কাজ শুরুর আগে বিআইব্লিউটিএ নকশায় অনাপত্তি দেয়ার পরেও নির্মাকাজের মাঝামাঝি সময় আপত্তির মুখে গত কয়েক বছর ধরে কাজ বন্ধ থাকে। পরে দুটি দপ্তরের মধ্যে চিঠি চালাচালি ও একাধিক বৈঠকের পর সমঝোতার আলোকে ২০২৩ সালে সেতুর মধ্যবর্তী স্প্যানটি মূল নকশার চেয়েও যতটা সম্ভব উঁচু করে নির্মানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে নেহালগঞ্জ সেতুটির ক্ষেত্রেও। সেখানেও দীর্ঘ সময় পর মধ্যবর্তী স্প্যানটি অপক্ষোকৃত উচ্চতায় স্টীল স্ট্রাকচারে নির্মানের সিদ্ধান্তের পরে নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। উভয় সেতুর ক্ষেতেই নির্মাণ খরচ বেড়েছে। বিআইডব্লিউটিএ’র সাথে সমঝোতার আলোকে নেহালগঞ্জ সেতুটির মধ্যবর্তী এক’শ ফুটের স্প্যানটিকে ইস্পাতের অবকাঠামোতে নির্মাণ করতে গিয়ে নকশার পরিবর্তন ও সংশোধন করা হয়েছে। ৩৬ ফুট প্রশস্ত এ সেতুটিতে যানবাহন চলাচলের জন্য মূল অংশটি ২৪ ফুট বলে জানা গেছে। তবে নেহালগঞ্জ সেতুর সংযোগ সড়কের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা কাটেনি এখনো। তাই বন্ধ আছে এ অংশের কাজ।
দুটো ব্রীজের ঠিকাদার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাহফুজ খান। তিনি স্পাম জটিলতার পর থেকেই এই কাজে আর আগের আগ্রহ ধরে রাখতে পারেননি। কেননা, কাজ গ্রহণকালীন দরপত্র সময়ের বাজার দরের সাথে এখনকার বাজারদরে আকাশ পাতাল পার্থক্য। লাভের তুলনায় উল্টো ক্ষতি গুনতে হচ্ছে এই কাজে জানিয়ে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এম মাহফুজ খান গত বছর বলছিলেন, যে কাজে ওই সময় ব্যায় হতো ৫০-৬০ কোটি টাকা। সেই একই কাজে এখনকার ব্যায় তিনগুণ বেড়েছে। তাছাড়া প্রকৌশলগত প্লানিং ভুলতো কর্তৃপক্ষের। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও তার খেসারত দিতে হচ্ছে বলেই কাজটি এতো বিলম্ব হচ্ছে।
মাহফুজ খান বলেন, গোমা সেতুর একটি স্পাম বাকী। এ নিয়ে রি-টেন্ডার হয়েছে। কাজটি আমার প্রতিষ্ঠানই পুনরায় পেয়েছে।
নেহালগঞ্জ সেতুর রি-টেন্ডার তারই পরিচিত ঢাকার একজন ঠিকাদার পেয়েছেন। তিনিই কাজটি করছেন। জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতায় তিনগুণ দামে সমস্যার সমাধান হয়েছে জানতে পেরেছি। এসব জটিলতার কারণে নেহালগঞ্জ সেতুর পুন:টেন্ডারে আর অংশ নেননি বলে জানান মাহফুজ খান ।
এদিকে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে গোমা সেতুর জন্য পরপর তিনবার ঠিকাদার পাননি বলে জানিয়েছিলেন বরিশালের সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ মাহবুব সুমন। তিনি বলেন, চতুর্থ দফা দরপত্র আহ্বান করার পর গোমা সেতুর কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। যেকোনো সময় এটির কাজ সম্পন্ন হবে। তবে নেহালগঞ্জ সেতুর জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা কাটেনি। জমি অধিগ্রহণ চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া গেছে, শীঘ্রই জমির মালিকদের তা বুঝিয়ে দেয়া হবে। স্পাম তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। আগামী বছর এপ্রিল বা মে মাসে এটি হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল ইসলাম এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই জানেন না, তবে তিনি দুটি ব্রীজ পরিদর্শন করে বিস্তারিত বলবেন বলে জানিয়েছেন।