নিজস্ব প্রতিবেদক :: শিক্ষক সং.ক.টে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজে ৬৫ ভাগ পদ শূন্য।
শিক্ষক সংকটে দেশের অন্যতম বৃহৎ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজটিতে শিক্ষা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ছে। ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যাপক,সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক এর ২৪৮টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৮৯জন। ১৫৯টি পদেই কোন শিক্ষক নেই। এছাড়া এ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ৮৪টি কিউরেটর, প্রভাষক,প্যাথলজিষ্ট, মেডিকেল অফিসার, বায়োকেমিষ্ট ও ফার্মাসিষ্ট পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৫৭ জন। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ৩৩২টি পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৪৬জন। ১৮৮টি পদে কোন শিক্ষক সহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নেই।
অনুমোদিত পদের ৬৫ ভাগেরও বেশী শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় প্রায় ৬ দশকের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ সরকারি চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যানরত ছাত্রÑছাত্রীদের লেখাপাড়ার মান নিয়েও প্রতিনিয়ত প্রশ্ন উঠছে। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৬০ বছর পরেও ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, কিউরেটর, প্রভাষক, প্যাথলজিষ্ট, মেডিকেল অফিসার ও বায়োকেমিষ্ট-এর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর অর্ধেকের পদায়নও নিশ্চিত করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সহ অধিদপ্তর। ফলে শূন্য পদের সংখ্যাটা কেবল বেড়েছে, তীব্রতর হচ্ছে সংকট।
শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজের লাগাতার এ শিক্ষক সংকটে সংলগ্ন হাসপাতালটিতেও চিকিৎসাসেবা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। পুরো হাসপাতালটিতে দীর্ঘ দিনের নানা অব্যবস্থা অনিয়ম আর দুর্নীতির হাত ধরে চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভয়াবহ সংকটের মধ্যে সম্প্রতি পরিচালক পদে আর্মি মেডিকেল কোর থেকে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে পদায়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন পরিচালক হাসপাতলটির দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা সমাধানে আন্তরিক প্রচেষ্টা শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। তবে কলেজে শিক্ষক সংকটের রেশ ধরে হাসপাতালটিও অচলাবস্থার মুখে।
১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আবদুল মোনয়েম খান বরিশাল মেডিকেল কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পরে ১৯৬৮ সালের ২০ নভেম্বর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার একমাত্র চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরিশাল মেডিকেল কলেজটির উদ্বোধন করেন। ১৯৭৮ সালে মেডিকেল কলেজটি সংযুক্ত হাসপাতালটির নিজস্ব ভবন উদ্বোধনকালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অবিভক্ত বাংলার গভর্ণর ও বরিশালের কৃতি সন্তান শের ই বাংলার নামে এ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালটির নামকরণ করেন।
কিন্তু শিক্ষক সংকটে ঐতিহ্যবাহী এ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা ব্যবস্থা এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের কবলে। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষক সংকটের মধ্যেও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে মঞ্জুরিকৃত পদের ৮০ ভাগ শিক্ষকও নিয়োগ না দেয়ায় সংকট ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মোঃ ফয়জুল বাশার।
শিক্ষক সংকটে এখানে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও হাতাশা ভর করছে। এমনকি চিকিৎসা শিক্ষার ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৬৫ ভাগ শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক অত্যাবশ্যকীয় বিষেয়েও পাঠদান সম্ভব হচ্ছেনা ।
সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজে ৫১জন অধ্যাপকের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৪জন। সহযোগী অধ্যাপকের ৭৪টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ৩৩জন। আর সহকারী অধ্যাপকের ১২৩টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ৫২ জন।
এছাড়াও চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে দুজন কিউরেটর পদের বিপরীতে কোন শূন্য পদ না থাকলেও ৭২ জন প্রভাষকের আছেন মাত্র ৪৮জন এবং ৬জন মেডিকেল অফিসারের ৫জন কর্মরত থাকলেও একজন করে বায়োকেমিষ্ট ও ফার্মাসিষ্ট পদে কোন জনবল নেই।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির এনাটমি বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক সহ মেডিসিন ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের পদগুলো শূন্য থাকার মধ্যে কোন কোন বিভাগে প্রভাষকের পদটিও শূন্য। মেডিসিন বিভাগের ৬টি অধ্যাপকের পদই শূন্য। এমনকি এ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপকের ৩টি ও সহকারী অধ্যাপকের ৪টি পদেও কোন শিক্ষক নেই। ফিজিক্যাল মেডিসিন এবং নিউরো মেডিসিনের অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের পদগুলো শূন্য পড়ে আছে মাসের পর মাস।
কলেজটির দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারী, ফিজিওলজি, বায়োকেমেষ্ট্রি, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, প্যাথলজি, শিশু, ডার্মাটোলজী, নেফ্রোলজী, সাইকিয়েট্রি, ফিজিক্যাল মেডিসেন এন্ড রিহ্যাবিলেটসন, নিউরো মেডিসিন, শিশু সার্জারী, নিউরোলজী, শিশু হেমাটলজী ও অনকোলজী, অর্থপেডিক সার্জারী, জেনারেল ও ক্লিনিক্যাল নিউরোসার্জারী, চক্ষু, অর্থপেডিক সার্জারী ও ট্রমাটোলজী, রেডিও এন্ড ইমেজিং, বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারী, গ্যষ্ট্রোএন্টারোলজী, ইউরোলজী, হেমাটোলজী, হেপাটোলজী, নিউনেটালজী, জেনারেল ও ক্লিনিক্যাল নিউরোলজী, রিউমাটোলজী, জেনারেল ইএনটি, অটোলজী, রেনোলজী, হেডনেক সার্জারী, ইউরো গাইনোকোলজী এবং চিলড্রেন ডেন্টিষ্ট্রি বিভাগগুলোর অধ্যাপকের পদগুলোতেও কোন নিয়মিত শিক্ষক নেই দীর্ঘদিন।
এছাড়া ফিজিওলজি, ফরেনসিক মেডিসেন, মাইক্রো বায়োলজী, কমিউনিটি মেডিসিন, ফিজিক্যাল মেডিসিন, নেফ্রোলজী, প্যাথলজি, নিউরো মেডিসিন, অর্থোপেডিক, নাক-কান-গলা, রেডিও থেরাপী, ইউরোলজী, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারী, এন্ডোক্রাইনোলজী ও মেটাবলিক, নিউনোটলজী ও রিউমাটোলজী বিভাগে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের পদগুলোও শূন্য। পাশাপাশি রেসপিরেটরী মেডিসিন, হেপাটলজী, রেডিওথেরাপী, এনসথেসিওলজী, রেডিওলজী ও ইমেজিং, চক্ষু, স্পোর্টস মেডিসিন ও অর্থোসকপি, অর্থোপেডিক, সার্জারী, ফার্মাকোলিজী ও বায়োকেমেষ্ট্রি সহ আরো কয়েকটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদগুলো শূন্য পড়ে আছে দীর্ঘদিন ।
এমনকি কলেজটির এনাটমি, ডার্মাটোলজী, সাইকিয়াট্রি, গ্যাসট্রো এন্টারোলজী, জেনারেল ও ক্লিনিক্যাল নিউরো সার্জারী, স্পোর্টস মেডিসিন এন্ড অর্থোসকপি, এনেসথেসিওলজী, রেডিওথেরাপী, হেমাটোলজী, রেসপিরোটরী মেডিসিন, গাইনী, শিশু হেমাটোলজী এন্ড অনকোলজী, রিউমাটোলজী, জেনারেল ইএনটি, অটোলজী, রেনোলজী, হেডনেক সার্জারী, পেডিয়েট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজী এন্ড নিউট্রেশন, রিপোডাক্টিভ ক্রাইনোলজী এন্ড ইনপারলিটি, ফটোমেন্টারনাল মেডিসিন, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগগুলোতে কোন সহযোগী অধ্যাপক নেই। এ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বেশীরভাগ বিভাগেই অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের সব পদই শূণ্য। অনেক বিভাগেই শুধুমাত্র সহকারী অধ্যাপকের মত জুনিয়র শিক্ষকরাই সবে ধন নিলমনি। যারা নিজ পদ থেকে শুরু করে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক সহ বিভাগীয় প্রধানেরও দায়িত্ব পালন করছেন।
শেল ই বাংলা মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল বিভাগে প্রতিবছর প্রায় অর্ধশত ছাত্রÑছাত্রী ভর্তি হলেও সেখানে শিক্ষা দেয়ার মত তেমন কোন শিক্ষকই নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ডেন্টাল বিভাগের ডেন্টিষ্ট্রি, সাইন্স অব ডেন্টাল মেটিরিয়াল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং,ডেন্টাল ফার্মাকোলজি, পেরিও ডন্টোলজী, ডেন্টঅল পাবলিক হেলথ, ওরাল ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারী,কনজার্বেটিভ ডেন্টিষ্ট্রি এন্ড এন্ডোডন্টিকস, রিমোভেবল অর্থোডেন্টটিক্স ও রিমোভেবল প্রস্থোডেনটিক্স বিভাগে কোন সহযোগী অধ্যাপক নেই। এ বিভাগের প্রায় সবগুলো সহকারী অধ্যাপকের পদগুলোও শূন্য। ফলে শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজে দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র দন্ত চিকিৎসা শিক্ষার দ্বার ক্রমশ রুদ্ধ হতে চলেছে।
কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মোঃ ফয়জুল বাশার বলেন, করোনাকালে ১৯ মাস ক্লাস বন্ধ ছিল। এসময়ে অনেক শিক্ষক অবসরে গেছেন। ফলে ঐসব শূন্যপদে জনবল নিয়োগে যে বিলম্ব ঘটে, তা কাটিয়ে ওঠা এখনো সম্ভব হয়নি। সমস্যায় থাকলেও কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম নির্বিঘœ রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত আছে। সঠিক যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে পদোন্নতি দিয়ে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের পদগুলো যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করা যেতে পারে।