ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২৪ এপ্রিল ২০২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সাংবাদিকতা হোক পেশাদারিত্বের প্রতীক : আবু আহমেদ জাফর   

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
এপ্রিল ২৪, ২০২৫ ১০:০৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আবু আহমেদ জাফর :: সাংবাদিকতা হোক পেশাদারিত্বের প্রতীক

 

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশাটি এখন সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অনেক সময় সাংবাদিকদের পেশাগত অবস্থান নয়, বরং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়েই গণমাধ্যমে আলোচনা তৈরি হয়। সাংবাদিক যখন কোনো রাজনৈতিক দলের পদে আসীন হন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অথচ সাংবাদিকতা পেশার মর্মবাণীই হলো—নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যভিত্তিক সংবাদ পরিবেশন।

রাজনৈতিক দলে পদ নয়, পেশাদারিত্ব হোক মুখ্য:

এই প্রেক্ষাপটে সময় এসেছে সাংবাদিকদের রাজনৈতিক দলের পদে না রেখে বরং পাবলিক রিলেশন অফিসার (পিআরও) বা মিডিয়া সেল কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা করার। এতে করে সাংবাদিকরা পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে দলীয় কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করতে পারবেন, আবার রাজনৈতিক দলে দোসর হয়ে পড়ার দায় থেকেও মুক্ত থাকবেন।

পিআরও বা মিডিয়া সেলের দায়িত্বে থাকা সাংবাদিকরা চুক্তিভিত্তিক নির্দিষ্ট মেয়াদে নিয়োগ পেতে পারেন। কেন্দ্র থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও একই কাঠামো অনুসরণ করা যেতে পারে। এতে করে দলগুলোর প্রচার কার্যক্রম পেশাগত ও সুশৃঙ্খল হবে।

সম্মানীভিত্তিক দায়িত্ব, নয় রাজনৈতিক আনুগত্য:
পিআরও হিসেবে নিযুক্ত সাংবাদিকরা মাসিক সম্মানী বা নির্ধারিত ভাতা পাবেন। তাদের প্রধান কাজ হবে—দলীয় প্রেস বিজ্ঞপ্তি তৈরি ও পাঠানো, মিডিয়ার সঙ্গে সমন্বয় রাখা এবং দলের বক্তব্য যথাযথভাবে উপস্থাপন করা। এর সবটাই হবে একটি পেশাদার কাঠামোর মধ্যে থেকে—যা সাংবাদিকতার মৌলনীতি বা নৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না।

সাংবাদিকতা যেন না হয় রাজনৈতিক অনুগত্যের হাতিয়ার:
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কোনো সাংবাদিক যখন সরাসরি রাজনৈতিক পরিচয়ে সংবাদ প্রচার করেন, তখন সেটি গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা—উভয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এক সময় সাংবাদিকরা ছিলেন সমাজের দর্পণ। কিন্তু এখন অনেকে রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছেন—যা পেশাটির জন্য অশনি সংকেত।

আমরা লক্ষ্য করেছি, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সাংবাদিকদের দলীয় পরিচয়ে নিযুক্ত করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। ফলে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই সাংবাদিকরা হয়রানি, মামলা-মোকদ্দমা এমনকি দেশত্যাগেও বাধ্য হচ্ছেন।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও চাপ: বাস্তব অভিজ্ঞতা:
দৈনিক প্রথম আলো, নয়াদিগন্ত, ইসলামিক টিভি, ভোরের কাগজসহ দেশের অনেক গণমাধ্যমই কখনো না কখনো ক্ষমতাসীন দলের রোষানলে পড়েছে। শুধু প্রথম আলোর বিরুদ্ধেই ১৯৯৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত শতাধিক মামলা হয়েছে। সরকারের চোখে সাহসী সাংবাদিকতা মানে শত্রুতা আর প্রশংসা মানেই তেলবাজি—এই মনোভাব আজ সংবাদমাধ্যমের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলেছে।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন পত্রিকা, বিশেষত প্রথম আলো যখন জনগণের পক্ষে অবস্থান নেয়, তখন তাৎক্ষণিকভাবে তারা নতুন শত্রুতে পরিণত হয়। এমন বাস্তবতায় সাংবাদিকতা যেন আর নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার নয়, বরং রাজনৈতিক ‘বয়ান’ তৈরির খেলায় রূপ নিয়েছে।

সমাজের নেতৃত্বে থাকা পেশাজীবীদের রাজনীতিকরণ:
আমরা লক্ষ্য করছি, সরকারি চাকরিজীবী, আইনজীবী, চিকিৎসক, ইমাম এমনকি সাংবাদিকরাও সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে করে তাদের পেশাগত সম্মান নষ্ট হচ্ছে। ফলে এইসব পেশায় নতুন প্রজন্মের আগ্রহও কমছে। ভবিষ্যতে আমরা হয়তো মেধাশূন্য সাংবাদিকতা দেখতে বাধ্য হব।

সময় এসেছে বিভাজনের: রাজনীতি আর সাংবাদিকতা আলাদা থাকুক:
সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি—এই দুটি পেশা একে অপরের পরিপূরক নয়। একজন সাংবাদিক রাজনৈতিক মতাদর্শ পোষণ করতেই পারেন, কিন্তু সেটিকে পেশাগত কাজে প্রভাব ফেলতে দেওয়া অনুচিত। যদি এই দুই পেশাকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা না যায়, তবে গণমাধ্যমের প্রতি জনআস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে।

প্রস্তাবনায় যা থাকছে:
১. রাজনৈতিক দলে সাংবাদিকদের পিআরও বা মিডিয়া সেল কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ।
২. চুক্তিভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ের দায়িত্ব প্রদান।
৩. পেশাগত সম্মানীভিত্তিক ব্যবস্থা।
৪. সাংবাদিকতা ও রাজনীতি বিভাজনের স্পষ্ট নীতিমালা।
৫. দলীয় সাংবাদিকতার পরিবর্তে পেশাদার প্রচার কাঠামো গড়ে তোলা।

উপসংহার: এখনই সময় রাজনৈতিক দল, সরকার, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিক সংগঠনগুলো বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেয়। সাংবাদিকদের পেশাদার অবস্থান নিশ্চিত না হলে এই পেশা ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগোবে।

একটি জাতির গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা এবং স্বাধীনতা—সবকিছু নির্ভর করে তার সাংবাদিকতার উপর। তাই আসুন, দলীয় পদ নয়, বরং পেশাদারিত্বে আস্থা রেখে এই পেশাটিকে রক্ষা করি।

লেখক: আহমেদ আবু জাফর

চেয়ারম্যান, ট্রাস্টি বোর্ড, বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম (বিএমএসএফ)