ঢাকাশুক্রবার , ১৮ জুলাই ২০২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

বরিশালের হালিমা খাতুন স্কুলের শিক্ষক মহিউদ্দিনের লাশ উদ্ধার, মৃত্যু না হত্যা

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
জুলাই ১৮, ২০২৫ ১:০৫ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

মামুনুর রশীদ নোমানী  :: বরিশাল নগরীর হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজীর শিক্ষক মোঃ মহিউদ্দিন। একজন প্রতিবাদী শিক্ষক।অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ভুগতে ছিলেন নিরাপত্তাহীনতায়।সব সময় আতংকের মাঝে বসবাস করতেন।তাকে স্কুলে ও স্কুলের বাইরে স্কুলটির কয়েকজন শিক্ষক ,শিক্ষিকা ও সন্ত্রাসীরা প্রান নাশের হুমকি দিয়েছে।স্কুলটিতে সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে হেনস্থা হয়েছেন অসংখ্যবার। হেনস্থা ও হুমকির কারনে মোঃ মহিউদ্দিন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়।মহিউদ্দিনকে হত্যা করা হতে পারে এমনটি মনে করেন তার পরিবার। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা হবে হত্যা মামলা ।

বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) রাতে নগরীর করিম কুটির এলাকার মসজিদ গলির ‘স্মরণিকা ভিলা’র নিচ তলার একটি কক্ষ থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত মো. মহিউদ্দিন উজিরপুর উপজেলার হরিদ্রাপুর গ্রামের মৃত আব্দুল আজিজ মাঝির ছেলে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে,বরিশাল নগরীর হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজীর শিক্ষক মোঃ মহিউদ্দিন ২০২৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর স্কুলটির তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বরিশালের জেলা প্রশাসকের নিকট প্রান নাশের হুমকি বিষয়ে লিখিত আকারে জানান।

লিখিত অভিযোগে জানান,আমি সিনিয়র শিক্ষক মোঃ মহিউদ্দিন(ইংরেজী),হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়,বরিশাল।আমাকে বিভিন্ন সময়ে বাইরের লোকজন দিয়ে নানা ভয়ভীতি ও প্রান নাশের হুমকি প্রদান করেন প্রধান শিক্ষক এ এস এম ফখরুজ্জামান ও সাবেক ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা।ইদানিং শিক্ষক মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা,বানোয়াট ,ভিত্তিহীন,কাল্পনিক,যোগসাযোসি যৌন হয়রানীর অভিযোগ এনে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে চাকরিচ্যুত করা হয়।আমি সম্মানিত শিক্ষক মাইদুলের পক্ষে স্বাক্ষী দিতে গেলে আমাকে হত্যা করা হবে বলে প্রধান শিক্ষক এর বাইরের কয়েকজন লোক আমার প্রান নাশের হুমকি দিচ্ছে।আমি একজন শিক্ষক হিসেবে এহেন অন্যায় নিজ চোখে দেখে বিবেকের তারনায় প্রশ্রয় দিতে পারিনা। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করেন।

এছাড়া শিক্ষক মহিউদ্দিন ২০২৪ সালের ৯ মে হালিমা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সনদ বিহীন,জাল সনদে চাকুরীরত শিক্ষক,শিক্ষিকাদের তদন্ত ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য লিখিত আবেদন করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের উপ-পরিচালকের নিকট।

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলেন সেই সব শিক্ষক ও শিক্ষিকারা তাকে স্কুলে বসে হেনস্থা করতো।করতো লাঞ্চিত।করতো অপমান ও অপদস্ত।এসব কারনে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন এমনটি জানান মহিউদ্দিনের পরিবারের লোকজন ও তার সহকর্মীরা।

এদিকে ২০২৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মোঃ মহিউদ্দিন হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সনদ বিহীন নিয়োগ,জাল সনদে নিয়োগ, অর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে বরিশালের জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।

জেলা প্রশাসক অভিযোগ আমলে নিয়ে শিক্ষা শাখায় প্রেরন করেন। ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের শিক্ষা ও আইসিটি শাখার দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক উপমা ফারিসা
তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

 

কমিটির আহবায়ক করা হয় সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজেস্ট্রেট মোঃ আরিফুজ্জামানকে ।সদস্যরা হলেন সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজেস্ট্রেট আশরাফুজ্জামান পলিন ও সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসারকে। কমিটিকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অভিযোগের বিষয় সরেজমিন তদন্তপুর্বক সুস্পষ্ট মতামতসহ জরুরী ভিত্তিতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন।

তদন্ত কমিটি ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর অভিযোগকারী মোঃ মহিউদ্দিনকে তদন্তের জন্য হালিমা খাতুন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ৯ অক্টোবর বিকেল ৩টায় উপস্থিত থাকার জন্য নোটিশ প্রদান করেন।

 

তদন্ত কমিটি তদন্তের পরে রিপোর্ট প্রদানের পরে ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর বরিশারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ৮২ পাতা সম্বলিত তদন্ত রিপোর্ট মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠিয়ে দেন। জেলা প্রশাসক ২৬ নভেম্বর ‘২৪ তারিখ ৩৭৫ নং স্মারকে প্রেরিত পত্রে তদন্ত কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত তদন্ত প্রতিবেদনের সাথে একমত পোষন করে প্রতিবেদনটি সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রেরন করেন।

তদন্ত রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি।মহিউদ্দিন স্যার চলে গেছেন পরপারে অথচ তিনি বিচার চেয়ে বিচার পেলেননা জীবদ্দশায় ।এভাবেই মন্তব্য করেছেন মহিউদ্দিন স্যারের এক সহকর্মী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান,মোঃ মহিউদ্দিন স্যার ছিলেন একজন প্রতিবাদী শিক্ষক।প্রতিবাদ করাই তার কাল হলো। তাকে স্কুলে হেনস্থা ও হুমকি দেয়া হতো। ঐ শিক্ষক বলেন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে শহিদুল ইসলাম,নাজমা বেগম,মাসুদা বেগম ও একে এম জামাল অন্যতম।

২০২৫ সালের ১৫ মে স্কুলটির ম্যনেজিং কমিটির সভাপতি বরাবরে ৫ জন শিক্ষক একে এম জামালের নিয়ম বহির্ভুত ভাবে বিদ্যালয়ে চাকুরী বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। এই আবেদনের দ্বিতীয় স্বাক্ষরদাতা হলেন মোঃ মহিউদ্দিন।

২০২৫ সালের ১৫ মে স্কুলটির ম্যনেজিং কমিটির সভাপতি বরাবরে ৫ জন শিক্ষক একে এম জামালের নিয়ম বহির্ভুত ভাবে বিদ্যালয়ে চাকুরী বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। এই আবেদনের দ্বিতীয় স্বাক্ষরদাতা হলেন মোঃ মহিউদ্দিন।

 

অভিযোগ দেয়ার পরেই কার্য্যক্রম স্থগিত ঝালকাঠি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ফ্যাসিস্ট চুন্নু মাঝির আপন ভাই হালিমা খাতুন স্কুলের এ কে এম জামাল ও তাঁর দোসররা মহিউদ্দিনকে চাপের মুখে রাখে। এছাড়া একে এম জামাল স্কুলে বসেই মোঃ মহিউদ্দিনকে হুমকি প্রদান ও হেনস্থা করেন। এছাড়া মহিউদ্দিনের চাকুরী খেয়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন একজন শিক্ষক প্রতিনিধি।কমিটিতে অবৈধভাবে আসা ঐ শিক্ষক প্রতিনিধির ব্যাপারে আপত্তি করার কারনেই হুমকি দেয়া হয় বলে সুত্র জানায়।

 

হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন শিক্ষক জানান,মোঃ মহিউদ্দিন স্যার স্কুলটির দুর্নীতিবাজ ও অসৎ শিক্ষক শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে যমুনা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার, জেলা প্রশাসক,ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি,মাউশিসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকায় তার বিরুদ্ধে স্কুলটির একটি গ্রুপ হেনস্থা ও হুমকি দিয়ে আসছিল। এসব কারনে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন।

 

কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, মহিউদ্দিন একাই ভাড়া বাসায় থাকতেন। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা প্রথমে সন্দেহ করেন। রাতে দীর্ঘসময় কোনো সাড়া না পেয়ে তারা ৯৯৯-এ ফোন করলে পুলিশ গিয়ে খাটের উপর থেকে মৃত অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে। পরে সুরতহাল শেষে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, “ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। কেউ কোনো অভিযোগ দিলে বিষয়টি তদন্ত করা হবে।
এদিকে নিহতের পরিবার এটিকে হত্যা বলে দাবি করেছে।

মহিউদ্দিনের বড় ভাই, বরিশাল জিলা স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জসিমউদ্দীন অভিযোগ করে বলেন, হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের প্রতিবাদ করায় তার ভাইকে বারবার হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল। তিনি বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন।জসিমউদ্দীনের ভাষ্য, “বিদ্যালয়ের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ করার কারণেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

আরেক ভাই, বরিশাল বিএম স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, “আমরা এই ঘটনায় মামলা করব। এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, হত্যা।