
নিজস্ব প্রতিবেদক :: শ্রাবণের ভেজা সকালে শান্ত স্রোতে ভেসে বেড়াচ্ছে শত শত নৌকা—কোনোটায় শুধুই পেয়ারা আর মাঝি, কোনাটায় বসে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে পর্যটক। ঝালকাঠির ভিমরুলী যেন বর্ষাকালে জেগে ওঠা এক জলজ স্বর্গ। খালজুড়ে সারি সারি নৌকা, আর সেই নৌকাতেই গড়ে ওঠা পেয়ারা হাট। এ দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটক।
এ যেন শুধু ভাসমান বাজার নয়, প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এক উৎসব- ছন্দময় এবং অভাবনীয় এক অনুভূতি।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে এই ভাসমান হাট। চাষিরা ভোরে পেয়ারার বাগান থেকে ফল তুলে এনে নৌকায় সাজিয়ে রাখেন। আগে হাটে উচ্চ শব্দে ডিজে বাজত, তরুণদের দল হট্টগোল করত। এখন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞায় তা নেই। পরিবেশ বেশ শান্ত।
ঝালকাঠির ভিমরুলী শুধু হাট নয়, বরং সবুজে মোড়ানো এক অনুভূতির নাম। খালের দুই পাড় থেকে শাখা-নালার ভেতর ঢুকে, পাওয়া যায় পেয়ারা গাছের সারি। গাছের ডালে ঝুলে থাকা পাকা পেয়ারা, পানিতে ডিঙি নৌকার প্রতিচ্ছবি, আর মাঝেমধ্যে শালিক-পাখির ডাক, সব মিলিয়ে এক নির্মল অনুভব।
তবে সবচেয়ে মোহনীয় অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে বাগানের গভীরে। সরু নালায় নৌকা নিয়ে ঢুকতেই দুই পাশে গাছের ডাল এসে মাথার ওপর ঝুঁকে পড়ে। ছোট ডিঙি নৌকায় করে যখন একজন পর্যটক ঢুকে পড়েন সেই গহীন বাগানে, তখন চারপাশে শুধু সবুজ, পাখির শব্দ, আর নিস্তব্ধতা। মনে হয় শহরের কোলাহল ফেলে কোনও স্বর্গীয় জগতে প্রবেশ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, এটি রাতারগুলের চেয়েও মনকাড়া।
জানা যায়, পেয়ারা শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ ভাষা থেকে, যার উৎপত্তি মধ্য আমেরিকায়। প্রায় তিনশ বছর আগে পর্তুগিজদের হাত ধরে বাংলায় পেয়ারার আগমন ঘটে। তবে আটঘর-কুরিয়ানা-ভিমরুলী অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ শুরু হয় প্রায় দুইশ বছর আগে।
১৮৪৩ সালে আটঘরের পূর্ণচন্দ্র মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি বিহারের গয়াধাম থেকে সঙ্গে আনেন এক বিশেষ জাতের পেয়ারা। বীজ থেকে চারা তৈরি করে তা রোপণ করেন নিজের জমিতে। তার চাষ পদ্ধতি দেখে উদ্বুদ্ধ হন আশপাশের লোকজনও।
এই পেয়ারা ‘গয়া’ থেকে আসায় স্থানীয়ভাবে একে ডাকা হতো ‘গইয়া’। যেমন বরিশাল থেকে এলে ‘বরিশাইল্লা’, ঝালকাঠি থেকে ‘জালকাইড্ডা’- তেমনই পেয়ারা হয়ে ওঠে ‘গইয়া’। এখন আশপাশের ২২ গ্রামে এই পেয়ারার চাষ হয়।
ঝালকাঠি জেলার কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ৬০০ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়েছে। এর বেশিরভাগই কীর্ত্তিপাশা, নবগ্রাম ও গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় প্রায় ১০ হাজার কেজি পেয়ারা। ফলন কিছুটা কম হলেও দাম ভালো, প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায়।
পেয়ারা চাষি ভবেন্দ্রনাথ হালদার বলেন, আমার ১৫ একর নিজস্ব বাগান আছে। তবে এবার ফলন তুলনামূলক বেশ কম হয়েছে কিন্তু দাম মোটামুটি ভালো পাচ্ছি।
পাইকার রুবেল দুয়ারি বলেন, আমি অনেক বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে এ বছর পেয়ারার দাম অনেক বেশি। চালান উঠানোই খুব মুশকিল হবে। তবে প্রশাসনের কিছু উদ্যোগে আমরা শান্তিতে বেচাকেনা করতে পারছি। গত কয়েকদিন আগেও পর্যটকদের সাউন্ড সিস্টেমের শব্দে একে অপরের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতে পারতাম না। প্রশাসন সাউন্ড সিস্টেম নিষিদ্ধ করায় আমরা এখন নির্বিঘ্নে বেচাকেনা করতে পারতেছি।
পেয়ারা বাগানে ঘুরতে আসা নাসির উদ্দিন কবির বলেন, এটা শুধু একটা পর্যটন কেন্দ্র না, এখানকার মানুষ এই পেয়ারার ওপরই নির্ভর করে সারা বছর সংসার চালায়। পেয়ারা বিক্রি করে, বাজার বসিয়ে, দোকানপাট চালিয়ে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করছে। পর্যটকেরা আসছে বলে স্থানীয় অর্থনীতিও জমে উঠেছে। তবে কর্তৃপক্ষের উচিত এদিকটায় আরেকটু মনোযোগ দেওয়া। ভাসমান বাজারে নৌপুলিশের স্থায়ী টহল দেয়া উচিত। থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও ভালো হতো। কিছু পর্যটক পরিবেশ সচেতন নন, খাবারের প্যাকেট বা উচ্ছিষ্ট জিনিস পানিতে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করছেন। এ বিষয়ে সবারই সচেতন হওয়া উচিত।
ঝালকাঠি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, স্থানীয় জনগণ, পর্যটক ও সচেতন মহলের অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা ভসমান বাজার ও বাগানের ভেতরে সাউন্ড সিস্টেম নিষিদ্ধ করেছি, পাশাপাশি বড় ট্রলারও ওই এলাকায় নিষিদ্ধ করেছি। স্থানীয় গ্রাম পুলিশ ও ইউপি সদস্য-চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আশরাফুর রহমান বলেন, ঝালকাঠির ভিমরুলীর ভাসমান পেয়ারা বাজার সবার কাছেই একটি আকর্ষণের জায়গা। বছরের এই সময়টাতে প্রচুর পর্যটক সেখানে ভিড় করেন এমনকি বিদেশি পর্যটকরাও এখানে আসেন। এই সময়টাতে তরুণদের মধ্যে একটি অংশ সেখানে গিয়ে উচ্চস্বরে ডিজে গান বাজায়, অশ্লীল নৃত্য করে করে যা কেউই পছন্দ করে না এবং বেশ বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনা জারি করেছি কি কি করা যাবে আর কি কি করা যাবে না। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। এছাড়া আমাদের এখানে চাষিদের অনেক সময় উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার কারণে লাভ কম হয় বা অনেক ক্ষেত্রে হয়ই না। এজন্য জেলা কৃষি বিভাগকে তাদের প্রণোদনা ও যাবতীয় সহযোগিতার জন্য বলা হয়েছে।