
নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশাল সিভিল সার্জন অফিসের সাবেক হিসাব রক্ষক মুন্নি অঢেল সম্পদের মালিক।
স্বামীর তেমন আয় নেই। অথচ মেয়েকে পড়ান বেসরকারি মেডিকেল কলেজে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বানিয়েছেন তিনতলা ভবনের বাড়ি, যেই জমির দাম কোটি টাকার বেশি। বিলাসী জীবনযাপন আর অর্থবৃত্তের কারণে যেন মাটিতে পা পড়ছে না তার। তিনি হলেন বরিশাল সিভিল সার্জন অফিসের সদ্য সাবেক হিসাব রক্ষক জাহিদা আনোয়ার মুন্নি।
তার বিরুদ্ধে সিভিল সার্জন অফিসে দায়িত্বে থাকাবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আয়বহির্ভূত অঢেল সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। অভিযোগ রয়েছে, অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তের বিষয়টি টের পেয়ে মুন্নি স্বেচ্ছায় বদলি হয়েছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালে।
তবে সেখানে যোগদানের শুরুতেই অনিয়মে মেতেছেন মুন্নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মডেল ফ্যামিলি প্লানিংয়ে যোগদানের আদেশ দিলেও ২২ দিনে একদিনের জন্যও কর্মস্থলে যাননি তিনি। বরং হাজিরা দিচ্ছেন নিয়মিত।
অভিযুক্ত জাহিদা আনোয়ার মুন্নির দাবি, পরিচালকের নির্দেশেই তিনি নতুন মডেল ফ্যামিলি প্লানিংয়ে যোগ না দিয়ে কাজ করছেন শেবাচিম হাসপাতালে।
সিভিল সার্জন অফিস জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরিশাল সিভিল সার্জন আওতাধীন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকের সকল দরপত্র কার্যক্রম এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন জাহিদা আনোয়ার মুন্নি। তার সক্ষতা ছিল সিভিল সার্জন অফিসের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার এস কে পিপলাই-এর মালিক মরন বাবুর সঙ্গে।
এ কারণে আওয়ামী লীগের ১৭ বছরে একচেটিয়াভাবে সিভিল সার্জন অফিসের আওতাধীন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকের সকল কাজ পেয়ে এসেছে মরন বাবুর মালিকানাধীন পিপলাই এন্টারপ্রাইজ, আহসান ব্রাদার্স, বাপ্পি ইন্টারন্যাশনাল, মুন্নি ট্রেডার্স।
সিভিল সার্জন অফিসের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স দীনা এন্টারপ্রাইজ-এর সত্ত্বাধিকারী সাইফুল আজম শাহিন বলেন, “বিগত বছরগুলোতে সিভিল সার্জন অফিসের সকল টেন্ডারে অংশ নিলেও একটি কাজও পাইনি। একাধিক টেন্ডার বাতিল করে দেওয়া হয়েছে সামান্য অজুহাতে। শুধু আমিই নই—ঢাকার বড় বড় সাপ্লায়ার কোম্পানিগুলোকেও বাতিল করে কাকতালীয়ভাবে একচেটিয়াভাবে টেন্ডার পেয়েছে এস কে পিপলাই (মরন বাবু)।”
তিনি অভিযোগ করেন, “মরন বাবুর সাথে সুসম্পর্ক ছিল সাবেক হিসাব রক্ষক জাহিদা আনোয়ারের। তাকে নিয়ে সিভিল সার্জন অফিসে সিন্ডিকেট করেন মরন বাবু। যখন যেই সিভিল সার্জন আসতেন তাকেই ম্যানেজ করে টেন্ডার বাণিজ্য করতেন জাহিদা আনোয়ার। যার বিনিময়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা পেয়ে অঢেল সম্পদের মালিক এখন জাহিদা আনোয়ার মুন্নি।”
আরও পড়ুন: বেনাপোলে ধরা পড়লো মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা কোটি টাকার ব্লেড কারসাজি
বরিশাল নগরীর কাউনিয়া সোবাহান মিয়ারপুল এলাকায় নির্মাণ করেছেন ‘মৌটুসি প্যালেস’ নামের তিনতলা বাড়ি, যার বর্তমান বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। একমাত্র মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে। এছাড়াও নামে-বেনামে আয়বহির্ভূত সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে মুন্নির বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি জাহিদা আনোয়ার মুন্নির অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ ও দুদকে অভিযোগ দিয়েছেন কয়েকজন ঠিকাদার। এর প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়। সেই দুর্নীতির দায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় বদলি হন জাহিদা। সেখানে মোটা অংকের লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
৩০ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তাকে বদলি করা হয় বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে। ৮ অক্টোবর এই হাসপাতালে যোগদান করেন জাহিদা আনোয়ার। তবে হাসপাতালে পদ খালি না থাকায় তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পার্শ্ববর্তী মডেল ফ্যামিলি প্লানিংয়ের হিসাব রক্ষক হিসেবে। কিন্তু বদলির ২২ দিনেও নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেননি তিনি। অথচ নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন শেবাচিম হাসপাতালের হিসাব শাখায়।
সরেজমিনে মডেল ফ্যামিলি প্লানিং ক্লিনিকে দেখা যায়, জাহিদা আনোয়ারের সকল কাজ করছেন উচ্চমান সহকারী বজলুর রহমান। তিনি বলেন, “জাহিদা আনোয়ারকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে হাসপাতাল পরিচালকের একটি পত্র পেয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত তিনি এই অফিসে পা রাখেননি।” কে জাহিদা আনোয়ার বা কেনই বা অফিসে আসেন না, সে বিষয়ে অবগত নন বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে জাহিদা আনোয়ারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শেবাচিম হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে। এখান থেকে আমাকে মডেল ফ্যামিলি প্লানিংয়ের হিসাব রক্ষকের দায়িত্ব দিয়েছেন পরিচালক মহোদয়। তবে পরিচালক মহোদয়ই আবার আমাকে দাপ্তরিক কিছু কাজ করার জন্য হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন।” আয়বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন।
বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম মশিউল মুনীর বলেন, “কর্মস্থলে অনিয়ম পেলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না, সে যেই হোক। জাহিদা আনোয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে (শেবাচিম হাসপাতাল) তার আসার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এখানে পদ যেমন খালি নেই, তেমনি তার গ্রেডের সাথে এখানে পদায়নেরও কোনো সুযোগ নেই।”
এদিকে বরিশাল জেলার সিভিল সার্জন ডা. এসএম মনজুর-এ-এলাহী বলেন, “জাহিদা আনোয়ার এখান থেকে স্বেচ্ছায় বদলি হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে দুটি তদন্ত চলছে। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় থেকে এ তদন্ত করা হচ্ছে। তাছাড়া দুদকের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত চলছে বলে জানা নেই। তবে দুদক থেকে আমাদের কাছে কোনো তথ্য চাওয়া হলে তা সরবরাহ করে তাদের সহযোগিতা করা হবে।”