একটা সময় রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ছিল না। এটাই ছিল দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের প্রধান বাধা। পদ্মা সেতু চালুর দুই বছর পরও বরিশালে উন্নয়নের সূচনা কেন হয়নি– এ ব্যাপারে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বরিশালের প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি। এ জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর পরিবার। সরকারের ওপর ছিল তাঁর অসীম প্রভাব। তাঁর উদাসীনতা ও নানা কারণে প্রস্তাবিত কয়েকটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প ফেরত যায়।
সিঙ্গাপুরের যুক্তি
পদ্মা সেতু নির্মাণের পর রাজধানী থেকে দক্ষিণের শেষপ্রান্ত পায়রা সমুদ্রবন্দর ও কুয়াকাটা পর্যন্ত ২৬০ কিলোমিটার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বরিশাল নগরী থেকে কুয়াকাটা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে সড়ক ও আকাশপথে পায়রা সমুদ্রবন্দর ও কুয়াকাটায় যেতে হয় বরিশাল নগরী হয়ে। যে কারণে বরিশাল নগরী হলো ট্রানজিট পয়েন্ট। পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটায় আসা দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী-পর্যটকের আবাসস্থল হবে বরিশাল। ব্যবসাকেন্দ্রিক সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হবে। স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠবে ছোট-বড় শিল্পকারখানা। গোটা বিভাগে উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে বরিশাল। এতে বরিশালের ব্যবসা ও পর্যটন গুরুত্ব পাবে। এসব ভাবনা থেকে বরিশালকে সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত শহরের স্বপ্ন দেখানো হয়।
ফসকে গেছে মেগা প্রকল্প
পদ্মা সেতুর জন্য শিল্পায়নের সুফল পেতে ২০২০ সালে বরিশালে একটি অর্থনৈতিক জোন করার উদ্যোগ নেয় অর্থনৈতিক জোন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বেজা)। স্থান নির্বাচন নিয়ে বারবার সিদ্ধান্তহীনতায় প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। শুরুতে স্থান নির্ধারণ হয়েছিল হিজলা উপজেলাসংলগ্ন মেঘনার দুর্গম দ্বীপ চরমেঘায়। এলাকাটি ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম হওয়ায় মৎস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ঘোর বিরোধিতায় বাতিল হয়। এর পর বাবুগঞ্জ ও সর্বশেষ আগৈলঝাড়ার পয়সারহাটে অর্থনৈতিক জোন করার জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব হয়েছিল। অজানা কারণে প্রকল্পটি হারিয়ে যায়।
বাবুগঞ্জের রহমতপুর বিমানবন্দরসংলগ্ন বিমানঘাঁটি স্থাপনে ২০২০ সালে জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়। জমির মালিকদের ৪ ধারায় নোটিশও দেওয়া হয়। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ স্থানটি নিয়ে আপত্তি করেছিল। স্থানীয় তদারকির অভাবে বিকল্প স্থান খুঁজতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রকল্পটিও বাতিল হয়। নগরীসংলগ্ন দপদপিয়া সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে কোস্টগার্ডের আঞ্চলিক ঘাঁটি স্থাপনের ক্ষেত্রে একই ভাগ্য ঘটেছে। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরও জমির উচ্চমূল্যের অজুহাতে প্রকল্পটি ফেরত যায়।
জানা গেছে, বিমান ও কোস্টগার্ডের ঘাঁটির প্রকল্প ফেরত যেতে দায়ী স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা। অধিগ্রহণের খবর জেনে প্রস্তাবিত জমিতে অগণিত মতলবি আধাপাকা ঘর তোলা হয়। ভিটেবাড়ি দেখিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা কয়েক গুণ পেতে এটা করা হয়েছে। এতে অধিগ্রহণ খরচ স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পই ফেরত যায়।
২০১৮ সালে ২০০ শয্যার মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপনে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব উঠেছিল। পরে সেটির আর অগ্রগতি হয়নি। বাবুগঞ্জের দুর্গাসাগর দীঘি এলাকায় একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের প্রস্তাব আলোচনা ছাড়া কিছুই হয়নি।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। তিনি বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী থাকাকালে নগরীতে একটি পর্যটন মোটেল ও ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ নেন। মেরিন ওয়ার্কশপের ১ একর জমিতে প্রায় ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প গঠন করছিল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। জমির মালিক বিআইডব্লিউটিএ ও পর্যটন করপোরেশনের মধ্যে চুক্তি সই হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া এ ধরনের প্রকল্প করা যাবে না– এমন অজুহাতে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়নি। বিভাগীয় শহর বরিশালে পর্যটন করপোরেশনের কোনো স্থাপনা নেই। অথচ উন্নত আবাসন ব্যবস্থা নেই– এ অজুহাতে বরিশাল স্টেডিয়ামে কোনোদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আয়োজন হয়নি।
নগর উন্নয়নে কয়েকটি বিদেশি দাতা সংস্থা সিটি করপোরেশনে অর্থায়ন করে। এর মধ্যে বড় অর্থদাতা হলো জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা)। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অসহযোগিতা ও খামখেয়ালিতে জাইকাসহ সব দাতা সংস্থার অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যায়। একই কারণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক টাকাও উন্নয়ন বরাদ্দ পাননি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য সাদিক। ফলে নগরের উন্নয়ন তলানিতে পৌঁছায়।
জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির চেয়ারম্যান হলেন বরিশাল নগরের সন্তান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। জানা গেছে, জাইকা কমিশনের সদস্য হিসেবে এ দেশে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বুলবুলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সাদিকের সময় তখনকার জাপান রাষ্ট্রদূত বরিশাল সফর করে ৬৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প দিতে রাজি হয়েছিলেন। গুঞ্জন রয়েছে, মন্ত্রণালয় নিরুৎসাহিত করায় জাইকা সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। পরে আবুল খায়ের মেয়র হলে একই প্রকল্প নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছিল। তবে আবুল খায়েরের ধীরগতির কারণে জাইকা ফের মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
মেগা প্রকল্পগুলো ফেরত যাওয়া প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) মহানগর সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, যে নগরে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতার মধ্যে অতিলোভ ও একাধিক জনপ্রতিনিধির মধ্যে রেষারেষি থাকে, সেখানে এ ধরনের ঘটনাই ঘটে। বরিশালের ভাগ্যে সেটাই হয়েছে।