
নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশালে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে সচেতনতার ইতিবাচক ফল, প্রতিষেধক গ্রহণে সদর হাসপাতালে দীর্ঘ লাইন।
বরিশালের সদর হাসপাতালে দীর্ঘ লাইন। এখান থেকে বিনামুল্যে র্যাবিস ভ্যাক্সিন নিতে এসেছে অনেকেই। কেউ এসেছে বেড়ালের কামড় খেয়ে,কেউবা কুকুরের আঁচড়। আঘাত বেশি বা সামান্য হলেও জলাতঙ্ক প্রতিরোধের সচেতনতা ই তাদের নিয়ে এসেছে প্রতিষেধক দিতে।
র্যাবিস বা জলাতঙ্ক হলো একটি ভাইরাস জনিত জুনোটিক রোগ। যা কেবলমাত্র প্রানী থেকে মানুষের দেহে ছড়ায়। র্যাবিস বা জলাতঙ্ক এক সময় যার নাম শুনলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত, আজ সেটি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। বিভিন্ন বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশে র্যাবিস প্রতিরোধে এসেছে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি। এখন শুধু প্রয়োজন আতঙ্ক না ছড়িয়ে, সঠিক তথ্যে ছড়ানোর।
আক্রান্ত প্রাণী থেকেই মূলত ছড়ায় এই ভাইরাসটি। তবে সুস্থ প্রাণী থেকে ক্ষতি ছড়ানোর আশঙ্কা নেই এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, র্যাবিস প্রতিরোধ করা সম্পূর্ণ সম্ভব, যদি আক্রান্ত পশুর কামড়ের পর দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়া হয়। আক্রান্ত স্থান ১৫ মিনিট ধরে ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেললে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমে আসে।ভয় না পেয়ে প্রানীটি নিজে জলাতঙ্কে আক্রান্ত কি না তা চিহ্নিত করতে হবে।এজন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তারা।
প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও সিটি কর্পোরপশন কাজ করছে রাস্তার কুকুর এবং বিড়ালদের টিকা দেয়ার। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার কুকুরকে টিকা দেওয়া হয়েছে, যা র্যাবিস নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখছে।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ডা. মো. ইব্রাহীম খলিল বলেন, “র্যাবিস একটি শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য রোগ, কিন্তু একবার সংক্রমিত হলে এটি শতভাগ প্রাণঘাতী।” রোগটি নিরাময় করা সম্ভব নয়, তবে টিকা ও সচেতনতার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা যায়। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব ২০৩০ সালের মধ্যে কুকুর-জনিত র্যাবিসে মানব মৃত্যুহার শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য (Zero human deaths from dog-mediated rabies by 2030) নির্ধারণ করেছে। এই বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন একটি সামগ্রিক ও সমন্বিত উদ্যোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা (WOAH), খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর র্যাবিস কন্ট্রোল (GARC) যৌথভাবে “United Against Rabies Forum (UARF)” নামে একটি বৈশ্বিক কর্মসূচির অধীনে কাজ করছে, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যেই কুকুর-জনিত মানব র্যাবিস মৃত্যু সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা যায়।
তিনি আরও বলেন, “কুকুর ও বিড়াল আমাদের বন্ধু। আমাদের লড়াই তাদের বিরুদ্ধে নয় আমাদের লড়াই র্যাবিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে।”
প্রাণীপ্রেমী ইসরাত জাহান সুরাইয়া বলেন, আমাদের মাঝে ভয় টা এমন ছড়িয়েছে,যে আমরা কুকুর বেড়াল দেখলেই আঘাত করি। প্রতিবছরের মতো এবারও পথ কুকুরদের ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। ভ্যাক্সিনেশন করা প্রানী দিয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা তো নেই।আমার বাসায় ৭ টা বেড়াল। আমি ওদের ভ্যাক্সিন করিয়েছি।ওদের রোজ কামড়, আঁচড় আমি খাই। এখন ভয়ের কিছু নেই।
র্যাবিস আক্রান্ত প্রাণী চেনার উপায় সম্পর্কে এক প্রাণী ডাক্তার বলেন, র্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত কুকুর পাগলের মতো আচরণ করে। যেখানে যা পায়, তা ই কামড়ানোর চেষ্টা করে। ছুটছুটি করে। মুখ থেকে লালা পড়তে থাকে। সারাক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে। একপর্যায়ে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং মারা যায়।
বরিশাল সদর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা জানান, মানুষ এখন পোষা প্রাণীর সামান্য আঁচড়েও সচেতন হয়ে ভ্যাকসিন নিতে আসছেন। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো , আক্রান্তদের তিন ডোজ ভ্যাকসিনের মধ্যে প্রথম ডোজ সবাই নিলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজ নেওয়ার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
তবে বিভিন্ন সময়ে বরিশাল বিভাগের জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিনের সংকট দেখা দিচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিন না পাওয়ায় অনেক রোগীকে বেসরকারিভাবে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে, যা সাধারণ রোগীদের জন্য বড় ধরনের হয়রানি সৃষ্টি করছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মাঝে মাঝে সরবরাহে বিলম্ব হলেও তারা চেষ্টা করছেন চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে।
প্রাণী প্রেমিরা কুকুর নিধনের পরিবর্তে গণহারে কুকুরকে টিকাদান কার্যক্রম এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে জলাতঙ্ক নির্মূল করার ওপর জোর দিচ্ছেন।


