ঢাকাসোমবার , ১২ মে ২০২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

দেড়’শ বছরের ঐতিহ্যের স্টিমার : বরিশালে আবার ফিরে আসছে

ক্রাইম টাইমস রিপোর্ট
মে ১২, ২০২৫ ৬:২৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশাল এক নদীবিধৌত জনপদ। এখানকার প্রতিটি ঘাট যেন বহন করে এক জলযাত্রার ইতিহাস—যার কেন্দ্রে ছিল স্টিমার। একসময় দক্ষিণবঙ্গের মানুষের যাত্রা স্টিমার ছাড়া কল্পনাও করা যেত না। সেই স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায় ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। দেড় শ বছরের ঐতিহ্য যেন থেমে যায় নীরবে, অবহেলায়। তবে সেই থেমে যাওয়া ইতিহাস আবার ফিরে আসছে।

গত শনিবার বিকেলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বরিশালের মানুষের জন্য সুখবর দেন—আবার চালু হচ্ছে স্টিমারসেবা। ঘোষণার পর থেকেই নগরের বাতাসে যেন ফিরে এসেছে পুরোনো সেই হুইসেলের শব্দ, স্টিমারের ছলাৎ ছলাৎ ছন্দ আর যাত্রার উত্তেজনা। বান্দরোডের কীর্তনখোলা পাড়ের পরিত্যক্ত স্টিমারঘাটে এখনো প্রতিদিন কেউ না কেউ এসে দাঁড়ায়—কেউ স্মৃতিকাতর হয়ে, কেউ পুরোনো দিনের আশায়। এখন সেই অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।

বরিশাল বিএম কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শাহ সাজেদা বললেন, ‘স্টিমারে ভ্রমণের কত স্মৃতি আমাদের। বাতাসে ভেসে আসত স্টিমারের গগনবিদারী হুইসেল। মানুষ ছুটে যেত ঘাটে। সে এক অন্য রকম অনুভূতি।’ তিনি জানান, আবার স্টিমার চালুর উদ্যোগে তিনি ভীষণ আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ। স্টিমার ও লঞ্চ—উভয়ই নৌযান। কিন্তু তারা যেন ভিন্ন দুই সময়ের প্রতিনিধি। স্টিমার ছিল একধরনের ভাসমান প্রাসাদ; যার চালনা শক্তি ছিল শুরুতে কয়লার আগুনে সৃষ্ট বাষ্পে, পরে ডিজেলে।

এর বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বিশালাকার প্যাডেল হুইল। কাঠের অভ্যন্তর, দোতলা কাঠামো, প্রশস্ত বারান্দা ও প্রথাগত আসবাব স্টিমারের যাত্রাকে করে তুলত স্মৃতিময়। অন্যদিকে লঞ্চ হলো সময়ের তাগিদে উদ্ভূত আধুনিক এক মাধ্যম। আধুনিক ইঞ্জিনচালিত এ নৌযান বহুতল ও অধিক গতিসম্পন্ন। অভ্যন্তরে আধুনিক প্লাস্টিক বা ধাতব আসবাব, কৃত্রিম আলো ও চমকপ্রদ সাজ।

স্টিমারের যাত্রায় ছিল ধীরতা আর নীরবতা, লঞ্চের যাত্রায় থাকে যান্ত্রিক কোলাহল ও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাগিদ। স্টিমার ছিল নিজেই এক গন্তব্য, যার যাত্রা মনে থাকত আজীবন। আর লঞ্চ শুধু গন্তব্যে পৌঁছায়, স্টিমারের মতো স্মৃতির ভার বহন করে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্টিমারসেবার যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে ১৮৮৪ সালে। কয়লাচালিত প্যাডেল স্টিমার প্রথমে নারায়ণগঞ্জ ও পরে ঢাকা থেকে সরাসরি খুলনার নৌপথে চলাচল করত।

 

পথে চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, মোরেলগঞ্জ, হুলারহাট, সন্ন্যাসী, কাউখালী ঘাটে যাত্রাবিরতি দিয়ে খুলনায় ভিড়ত। ঔপনিবেশিক সময়ে খুলনার সঙ্গে ভারতের রেল যোগাযোগ শুরু হলে নৌপথে যাত্রী পরিবহন গুরুত্ব পায়। তখন ফ্লোটিলা কোম্পানির ১৪টি স্টিমার বহরে ছিল। পরে পিএস গাজী, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচা, পিএস টার্ন, পিএস সেলার মতো ঐতিহ্যবাহী স্টিমারের সংযোজন—সবই ছিল নদীমাতৃক সংস্কৃতির অমূল্য এক অধ্যায়।

বরিশালবাসীর কাছে স্টিমার শুধু যান ছিল না, ছিল নির্ভরতার প্রতীক। ঝড়বৃষ্টি, জোয়ারভাটা পেরিয়েও এই স্টিমার আপন গন্তব্যে পৌঁছে দিত যাত্রীদের। ছিল নিরাপদ ও আরামদায়ক। শতবর্ষ ধরে সেবা দেওয়া স্টিমারগুলো পর্যটকদের কাছেও ছিল এক আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায় বাস্তবতা। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন, সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন, লঞ্চমালিকদের দৌরাত্ম্য, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মতো নানা কারণে চাপে পড়ে স্টিমারসেবা।

যাত্রী ও নাব্যতা–সংকটে ২০১৯ সাল থেকে স্টিমার চলাচল সীমিত হয়ে যায়। খুলনার বদলে যাত্রা থেমে যায় মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত। সর্বশেষ এমভি মধুমতি ও এমভি বাঙ্গালি সপ্তাহে চার দিন ঢাকা-মোরেলগঞ্জ নৌপথে চলাচল করত। শেষ যাত্রাটি ছিল ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) অধীনে থাকা প্যাডেল স্টিমারগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচা, পিএস টার্ন নোঙর করা আছে ঢাকার কদমতলীতে। সেগুলো আর চলে না; নিঃশব্দে বলে চলে এক কালের গল্প।

বরিশাল যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আবদুর রশিদ বলেন, ব্রিটিশ আমলের এই প্রযুক্তিগত বিস্ময় ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিচিহ্নগুলোকে জাদুঘর বা পর্যটনভিত্তিক ভাসমান সংগ্রহশালায় রূপান্তর করা প্রয়োজন। এগুলো সভ্যতার চিহ্ন। জীবন্ত ইতিহাসের অংশ করে রাখতে সেগুলো সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন তিনি। স্টিমার ফেরাতে উদ্যোগ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আবেগের স্টিমার ফেরাতে আবার উদ্যোগ নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

 

এ নিয়ে গত শনিবার বিকেলে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী স্টিমারসেবা আবার চালু হবে। এ জন্য নৌপথে চলাচলকারী চারটি স্টিমার সংস্কারের কাজ চলছে। আগামী পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে অন্তত দুটি স্টিমার চালু করার পরিকল্পনা আছে। স্টিমারে ভ্রমণকারীদের জন্য এটি একটি বড় সুখবর হবে। স্টিমার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা জানান, দুটি স্টিমার চালুর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচা, পিএস টার্ন—প্যাডেল স্টিমারের মধ্যে পিএস অস্ট্রিচ ও মাহসুদ ঢাকা-বরিশাল নৌপথে পর্যটকদের জন্য চলাচল করবে। পিএস লেপচা ও টার্ন বরিশাল ও খুলনায় ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান বলেন, দুটি স্টিমার চালুর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিনে দুটি জাহাজ নির্মাণ শেষে সার্ভে প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষমাণ। তবে কবে নাগাদ চালু হবে, সপ্তাহে কত দিন চলবে ও ঢাকা থেকে গন্তব্য কোন পর্যন্ত হবে এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।