
মো: আম্মার হোসেন আম্মান :: বরিশালে ‘সাংবাদিক’ বেশি, সংবাদ কম! পরিচয়ে বাম্পার ফলন, পেশাদারিত্ব খুঁজে পাওয়া দায়
বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার জগতে এক অদ্ভুত চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে— বেরেছে পরিচয় ধাড়ি সাংবাদিক , কিন্তু সংবাদ লেখার সাংবাদিক প্রায় বিলুপ্তির পথে। চারদিকে যেন এক ‘বাম্পার ফলন’ চলছে তথাকথিত সাংবাদিকদের প্রভাব। হাতে মোবাইল, গলায় আইডি কার্ড—তাতেই সাংবাদিক! এদের জ্বালায় অতিষ্টিত বরিশালবাসী।
এই তথাকথিত সাংবাদিকরা ছুটে চলেছে আবাসিক হোটেল, বেকারি, ইটভাটা এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কোথাও যেন সাংবাদিকতার মূল কাজ, অর্থাৎ তথ্য অনুসন্ধান, যাচাই ও জনস্বার্থে উপস্থাপন—তা আর নেই। বরং অনেকেই অভিযোগ করছেন, অনেকেই এই পরিচয় ব্যবহার করে যাচ্ছেন চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি, ব্ল্যাকমেইলিং এর মত কর্মকাণ্ড।
বাইকের গায়ে PRESS স্টিকার, গলায় একটি ক্যামেরা ও কার্ড, আর ফেসবুকে সাংবাদিক!
নিত্যদিন বরিশাল শহরের রাস্তায় দেখা যায়, বিভিন্ন মোটরসাইকেলের সামনে বড় করে “PRESS” বা “সাংবাদিক” লেখা স্টিকার লাগানো—যাতে পুলিশও হাত না দেয়। অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই স্টিকারধারীদের অনেকেই প্রকৃত সাংবাদিক নয়। এরা সাংবাদিক পরিচয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, বিশেষ করে:
অবৈধ প্রভাব খাটানো
সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের হয়রানি
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক পাচার
টোল, পার্কিং, হোটেল ফ্রি সুবিধা নেওয়া
চাঁদাবাজি ও ভীতি প্রদর্শন
এই চক্রটি যেন একটি ‘সাংবাদিকতার ব্যাজ’ ব্যবহার করে অপরাধের ঢাল বানিয়ে ফেলেছে।
সিনিয়র সাংবাদিকরা বলছেন, পেশাগত সাংবাদিকতা এখন ভয়াবহ সংকটে। সাংবাদিকতা এখন কার্ডধারী পরিচয়ের চেয়ে বেশি কিছু নয়। সংবাদ লেখার ন্যূনতম যোগ্যতা, নীতিবোধ বা পাঠদর্শন ছাড়াই যারা-তারা হয়ে যাচ্ছে সাংবাদিক।
প্রতিকার কী?
এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে:
প্রেস কাউন্সিল ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনবিহীন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের তালিকা তৈরি করে নজরদারি বাড়াতে হবে।
স্থানীয় জেলা-উপজেলা প্রেসক্লাবগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে, কেবল যোগ্য ও নীতিনিষ্ঠদের সদস্যপদ দিতে হবে।
সাংবাদিকদের ট্রেনিং ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
সামাজিকভাবে মিথ্যা সাংবাদিকতাকে বর্জন করতে হবে, প্রকৃত সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সাংবাদিকতা কোনো শখ নয়, এটা দায়িত্ব ও সেবার পেশা। তাই সংবাদ লেখা নয়—সংবাদ সৃষ্টির নামে যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তাদের রুখতে হবে এখনই।
নেই নূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণহীন, অথচ তারাও ‘সাংবাদিক’!
আজকাল এমন অনেককেই দেখা যায় যারা জীবনে স্কুল-কলেজের গেটের বারান্দ ও পাড়ায়নি, অথচ সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করছে দাপটের সাথে। এদের নেই কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা, নেই সাংবাদিকতার মৌলিক প্রশিক্ষণ। অথচ তারাই এখন মাঠে-ময়দানে ‘সংবাদকর্মী’ নামের ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে—চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি, ব্ল্যাকমেইল, এমনকি মাদক ব্যবসা, চোরাচালান চক্রে সম্পৃক্ততার অভিযোগও রয়েছে বহুজনের বিরুদ্ধে।
আবার অনেকেই সাংবাদিকতার পরিচয়ে, রাজনৈতিক রক্ষাকবচ! হিসেবে ব্যবহার করছে।
একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো—বর্তমানে সাংবাদিক পরিচয়ের পেছনে রাজনৈতিক রক্ষাকবচ গড়ে তোলার প্রবণতা বেড়েছে। এক সময় যারা ছিলেন রাজনৈতিক ঘরানার কর্মী, তারাই ৫ আগস্টের আগে নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিত। আর এখন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও সাংবাদিক পরিচয়ে মাঠে নামছেন।
মূলত, নিজের রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল করতে কিংবা ভবিষ্যতে আইনগত ঝামেলা এড়াতে অনেক রাজনীতিবিদ এখন সাংবাদিক পরিচয়ে ‘নিরপেক্ষতার মুখোশ’ পরে আছেন। আবার অনেকেই সাংবাদিকতার আড়ালে রাজনীতিকদের দালালি ও অপপ্রচার চালানোয় লিপ্ত—সংবাদ নয়, বরং কার হয়ে ‘কাজ করে দেওয়া যায়’ সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল কাজ।
অনেকের কাছেই “প্রেস” কার্ড = পেশার নয়, প্রভাবের পরিচয়!
আজকাল কিছু লোকের কাছে “প্রেস” লেখা কার্ড যেন প্রভাব খাটানোর বৈধ লাইসেন্স। এ কার্ড দিয়ে হোটেল থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর, বাজার, ঘাট ইত্যাদি এমনকি প্রশাসন পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করার প্রবণতা বাড়ছে। এতে প্রকৃত সাংবাদিকরা যেমন অপমানিত হচ্ছেন, তেমনি সাধারণ মানুষ সংবাদকর্মীদের প্রতিও হয়ে উঠছে সন্দিহান।
নামধারী তথাকথিত সাংবাদিকদের কারণে প্রকৃত সাংবাদিকতার বিশ্বাস আজ প্রশ্নের মুখে
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা—সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে নির্ভীক অবস্থান, নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা, সমাজ পরিবর্তনের অগ্রপথিক হিসেবে কাজ করা। এক সময় জনগণ সাংবাদিকদের চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করত। একটি খবর ছাপা মানেই সেটির গুরুত্ব থাকত, সেটি নিয়েই মানুষ ভাবত, আলোচনা করত। কিন্তু আজ?
আজ সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। কারণ কিছু তথাকথিত ‘নামধারী সাংবাদিক’ নামের আড়ালে সাংবাদিকতার পবিত্রতাকে কলুষিত করছে। তারা নানা অসৎ উদ্দেশ্যে, স্বার্থের বশে, কৌশলে সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করে সমাজে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করছে, সাধারণ মানুষের চোখে সাংবাদিকদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে দিচ্ছে।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত সাংবাদিকরা—যারা রাতদিন পরিশ্রম করে সত্য অনুসন্ধান করেন, জনগণের পক্ষে দাঁড়ান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করেন। অথচ তাদেরই সম্মান, ভালোবাসা, আস্থা আজ জনগণের কাছে আর আগের মতো নেই।
এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। প্রয়োজন প্রকৃত সাংবাদিকদের সংগঠিত হওয়া, ভুয়া সাংবাদিকদের মুখোশ উন্মোচন করা, এবং সাংবাদিকতা পেশাকে কলঙ্কমুক্ত করা। সাংবাদিকতা যেন শুধুই একটি ‘পাস’ না হয়, বরং সত্য বলার সাহসী কণ্ঠ হয়ে উঠুক—সেটাই কাম্য।
একসময় সাংবাদিকতা ছিল সমাজ বদলের হাতিয়ার। গণমানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত এই মহান পেশা ছিল সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা, সত্যের প্রতিচ্ছবি। মানুষ বিশ্বাস করত—”যা খবরের কাগজে এসেছে, তা নিশ্চয়ই সত্য!” কিন্তু আজ, ২০২৫ সালের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এই বিশ্বাস কি আর আগের মতো অবিচল আছে?
উত্তর একটাই—না।
আজকের সমাজে এক শ্রেণির তথাকথিত ‘নামধারী সাংবাদিক’ সাংবাদিকতার সৎ ও আদর্শিক ভিত্তিকে ভেঙে দিচ্ছে নিজের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে। পকেটে একটা মাইক্রোফোন, গলায় একটা কার্ড ঝুলিয়ে অনেকেই সাংবাদিক পরিচয়ে যা ইচ্ছা তাই করছে। কেউ চাঁদাবাজি করছে, কেউ মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করছে, আবার কেউ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কাজে সাংবাদিকতার পরিচয় ব্যবহার করছে। এর ফলেই আজ প্রকৃত সাংবাদিকরাই প্রশ্নবিদ্ধ।
সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে
সাধারণ মানুষ আজ আর সহজে সাংবাদিকদের বিশ্বাস করে না। একটি খবর পড়ার পরেও অনেকে বলে, “আরে, এগুলা তো পেইড নিউজ!”, “ওরা টাকা খায় বলেই এমন রিপোর্ট করে!”, অথবা “সাংবাদিক মানেই তো আজকাল সন্ত্রাসী টাইপ!”—এই ধরণের মন্তব্যগুলো এখন প্রতিদিনই শোনা যায়। অথচ এই পেশায় যারা সততার সঙ্গে কাজ করছেন, দিনরাত তথ্য অনুসন্ধানে ছুটছেন, জীবন ঝুঁকি নিয়ে দুর্নীতি ফাঁস করছেন—তারা আজ অবহেলার পাত্র।
এ যেন সত্যিকারের সাংবাদিকদের জন্য চরম অপমান।
এখানে প্রশাসনের, মিডিয়া মালিকদের, সাংবাদিক সংগঠনগুলোর এবং সাধারণ জনগণের দায়িত্ব রয়েছে—
ভুয়া সাংবাদিকদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া
প্রেস কার্ড, সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ ও মিডিয়া হাউজের সত্যতা যাচাই করা
প্রকৃত সাংবাদিকদের সহযোগিতা করা ও তাদের সম্মান ফিরিয়ে আনা
সাংবাদিকতা পেশাটি কেবলমাত্র একটি পরিচয় বা কার্ডের ব্যাপার নয়—এটি একটি চেতনা, একটি নৈতিক দায়িত্ব। কিছু লোভী ও সুবিধাবাদীর কারণে এই পেশার সম্মান আজ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, এখনো দেশে হাজারো সৎ, নির্ভীক সাংবাদিক আছেন, যারা নীরবে-নিভৃতে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সুরক্ষা, স্বীকৃতি এবং সম্মান নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।
এই পেশাকে আবারও আস্থার জায়গা করে তুলতে হবে—যেখানে জনগণ বুক ভরে বলতে পারবে, “সাংবাদিক মানেই সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো একজন সৈনিক।”
সমাধান কী?
✅ তথ্য মন্ত্রণালয় ও প্রেস কাউন্সিলকে ভুয়া সাংবাদিক শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
✅ প্রেসক্লাবগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে যোগ্যতা যাচাই করে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
✅ সাংবাদিকতায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-স্বার্থ দূর করে পেশাগত মান ধরে রাখার জন্য সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
✅ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে সাংবাদিক পরিচয়ে অপকর্মে লিপ্তদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
✅ প্রকৃত সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে— তারা যেন এই ছদ্মবেশীদের কারণে অবহেলিত না হন।
সাংবাদিকতা একটি দায়িত্ব, এটি জাতির চতুর্থ স্তম্ভ
মুঠোফোন, ফেসবুক পেইজ আর রাজনৈতিক দালালি নিয়ে ‘সাংবাদিক’ সাজা মানুষদের রুখে না দিলে সমাজে বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি আর ন্যায়ের পরাজয় অনিবার্য। এখনই সময় সঠিক সাংবাদিকতাকে সুরক্ষা দিয়ে, ভুয়া ও স্বার্থান্বেষীদের মুখোশ খুলে দেওয়ার।